‘পাসপোর্ট-এনআইডিতে সমস্যা? ইনবক্স করুন’

পাসপোর্ট, বিআরটিএ, জন্ম নিবন্ধন ও এনআইডিসহ সরকারি অনেক সেবাই এখন ডিজিটাল। তাল মিলিয়ে অনলাইনের পথ ধরেছে দালালরাও। মহামারির কারণেও তাদের তৎপরতা বেড়েছে ব্যাপক আকারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেসবুকে সেবাগুলোর নামে খোলা হয়েছে অজস্র ভুয়া পেজ ও গ্রুপ। ‘বুস্ট’ করে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে কেউ কেউ। পোস্টে কমেন্ট করলেই যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে ইনবক্সে।

অনেককেই এসব পেজের সেবা পেতে উদগ্রীব দেখা গেছ। কেউ কেউ অনলাইনে এ দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন এ প্রতিবেদককে। সতর্ক হতে বলেছেন অন্যদের। দালালরাও তাদের দুয়েকটি কাজ 'সফল' করে বাকিদের প্রলুব্ধ করছেন অনৈতিক সুবিধা আদায়ে।

ভালো পোস্টের টোপ
একশ্রেণির দালাল আবার ঘটা করে পোস্ট দিয়ে বলছেন, ‘দালালদের কাছ থেকে সতর্ক থাকুন।’ এতে মানুষও হচ্ছে বিভ্রান্ত। কারণ এসব পেজে মাঝে মাঝে আবার ভালো পরামর্শও দিতে দেখা যায়। মূলত ওই পোস্টগুলোই হলো টোপ।

কেননা, ওইসব ভালো পোস্টের কমেন্টে অনেকেই নিজের সমস্যার কথা জানান। তখন ওই ব্যক্তিকে ‘রিপ্লাই’তে বলা হচ্ছে, ‘আপনার সমস্যার সমাধান পেতে আমাদের ইনবক্স করুন।’

অনলাইনে সক্রিয় দালালরা

ফেসবুক পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সরকারি সেবার নামে অসংখ্য ভুয়া পেজ সক্রিয় আছে। সবক্ষেত্রেই সেবাপ্রত্যাশীকে ইনবক্সে নক করতে কিংবা ফোন করতে বলা হচ্ছে। 

ফেসবুক ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও খুলছে দালালরা। বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম কিংবা সরকারের এসব সেবাখাতের নিজস্ব মনোগ্রাম ব্যবহার করা হচ্ছে গ্রুপগুলোতে। বিভ্রান্ত হয়ে এগুলোকে ভেরিফায়েড পেজ ভেবে বসছে অনেকে।

এক ব্যক্তির একাধিক গ্রুপ
কোনও ব্যক্তি একাধিক পেজও চালাচ্ছেন। আবার একাধিক গ্রুপ চালাতে দেখা গেছে একজন অ্যাডমিনকে। গত এক থেকে দেড় বছরে চালু হওয়া এসব গ্রুপের সদস্য হাজার থেকে শুরু করে লাখ পর্যন্ত ছাড়িয়েছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট, ভূমি ব্যবস্থাপনা, কর ব্যবস্থাপনাসহ সরকারের সেবাখাতের প্রায় সব নামেই একাধিক ভুয়া পেজ রয়েছে।

ভুয়া যত পেজ ও গ্রুপ
ইংরেজি ও বাংলার মিশেলে নাম রাখা ভুয়া পেজ ও গ্রুপগুলোর মধ্যে আছে- পাসপোর্ট তথ্য, ডিজিটাল সেবা, Epassport & Embassy solution, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হেল্প গ্রুপ বাংলাদেশ, জন্ম নিবন্ধন অনলাইন সেবা, BRTA help desk (বিআরটিএ তথ্য কেন্দ্র), ভূমি জরিপ শিক্ষা ও ভূমি সংক্রান্ত আইনি পরামর্শ, NID help desk official group- Bangladesh National id card, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন হারানো কার্ড উত্তোলন, National NID card service- জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা, নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ, বিআরটিএ হেল্প সেন্টার পাবলিক গ্রুপ, জন্ম নিবন্ধন ও আইডি সংক্রান্ত পরামর্শ, পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন, পাসপোর্ট হেল্প মাস্টার পাবলিক গ্রুপ, driving licence help- ড্রাইভিং লাইসেন্স হেল্প বিষয়ক গ্রুপ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন সংশোধন হেল্প সেন্টার, Bangladesh E passport NID card unofficial information group, Birth Certificate online help desk, National ID Card Help Centre Gtoup, পাসপোর্ট হেল্প লাইন, ভোটার আইডি জন্ম নিবন্ধন তথ্য হেল্প সেন্টার, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, বি আর টি এ তথ্য কেন্দ্র (BRTA HELP), E-passport and NID help zone (ই পাসপোর্ট এন্ড এনআইডি বাংলাদেশ), অনলাইন জন্ম নিবন্ধন এনআইডি সেবা, NID help centre of Bangladesh (জাতীয় পরিচয় পত্র সংশোধন ও সমাধান), latest info BD (পাসপোর্ট তথ্য, এনআইডি কার্ড সংশোধন তথ্য ও অনলাইন network বাংলাদেশ) ইত্যাদি।

এত ভুয়া পেজের আড়ালে ভেরিফায়েড পেজ বের করাই মুশকিল

এসব পেজের মধ্যে কিছু রয়েছে যেগুলো সহযোগিতামূলক পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে এখানেও দালালরা সক্রিয়।

নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনসহ আরও কিছু নামধারী ফেসবুক পেজের প্রোফাইলে নির্বাচন কমিশনের মনোগ্রাম ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে বোঝার উপায় নেই এটা ইসির নিজস্ব পেজ নাকি দালাল পরিচালিত পেজ।

ই পাসপোর্ট তথ্য সেবা নামে একটি ফেসবুক পেজের প্রোফাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ই-পাসপোর্ট সেবা কর্মসূচির উদ্বোধন করার ছবি দেওয়া হয়েছে। প্রাইভেট গ্রুপটির সদস্য প্রায় ৪০ হাজার।

তিনদিনে গেম খালাস
‘B R T A বি আর টি এ হেল্প সেন্টার’-এর অ্যাডমিন হাফেজ সাইয়্যেদ মো. আতাউর রহমান। ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্টকার্ড সংগ্রহের বিষয়ে সহযোগিতা চাইলে তিনি জানান, এখন স্মার্ট কার্ড বন্ধ রয়েছে। তবে আপনি চাইলে সংগ্রহ করে দেওয়া যাবে। ২০-৩০ হাজার টাকা লাগবে। 

নিজেকে তৃতীয়পক্ষ দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি বিআরটিএর কেউ নই। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করে দেবো। টাকাটা তো উনারা নেবেন। আপনার সিরিয়াল প্রথম দিকে নিয়ে আসবে। আগেভাগে কার্ড পাবেন।’

লাইসেন্সের টাকা জমা দিয়ে একই দিনের মধ্যে ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন বলেও জানান তিনি।

‘পাসপোর্ট হেল্প মাস্টার’ অ্যাডমিন রবি উল্লাহ একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘যারা পাসপোর্টের বয়স, নিজের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন করতে পারছেন না, তাদের বলবো, এদিক ওদিক না ঘুরে ইনবক্স করুন আমাদের। ১৪/১৫ দিনে বই করে দেবো।’  

একটি পাসপোর্টের দুটি পাতার ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘নিজের নাম চেঞ্জ। বাবার নাম পুরো চেঞ্জ। ছবি চেঞ্জ করতে আজ ৬/৭ মাস ধরে বিভ্রান্ত হয়ে আসছিল এই ভাই। ওনার থেকে ১৪ দিন টাইম নিয়েছিলাম। মাত্র তিনদিনে গেম খালাস।’

এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গ্রাহকদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান বা সেবা সংক্রান্ত তথ্য জানাতে আমাদের একটি ('Bangladesh Election Commission Secretariat') ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি এবং এনআইডি উইংয়ের একটি ফেসবুক পেজ (National ID card জাতীয় পরিচয়পত্র) রয়েছে। এ ছাড়া মাঠ প্রশাসনে আমাদের দফতরগুলোর ফেসবুক আইডি/পেজ রয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনও পেজ অথরাইজড নয়। আমাদের নামে ভুয়া পেজ চালানো হলে সেটির লিংক বিটিআরসিকে চিঠি দিয়ে বন্ধ করার অনুরোধ করা হবে।’