(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ২৮ জুলাইয়ের ঘটনা।)
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গ যদি অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে এবং তাদের সম্পদ উন্নয়নশীল দেশে নিয়োজিত করে, তাহলে শুধু এশিয়া নয়—সমগ্র বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস পাবে। ১৯৭৩ সালের এই দিনে (২৮ জুলাই) বেলগ্রেডে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, তার দেশ শান্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, ‘যেহেতু দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ মত ও সাদৃশ্যপূর্ণ সমঝোতা রয়েছে, তাই উভয় দেশই বিশ্ব শান্তির জন্য একযোগে কাজ করে যেতে পারবে।’
এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। কিন্তু পাকিস্তানকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে এবং আচরণগত পরিবর্তন আনতে হবে। আর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত—শোষক ও শোষিত।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শোষণ বন্ধ করা না হলে দেশে স্থায়ী শান্তি স্থাপিত হতে পারে না। এতে শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম দীর্ঘতর হবে।’ বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করেন যে একদিন এই সমস্যার সমাধান অবশ্যই হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যুগোস্লাভিয়ার সমর্থনের কথা তিনি উল্লেখ করেন। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, আসন্ন জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের সাফল্য সম্পর্কে তিনি আশাবাদী।
যুগোস্লাভিয়ার স্বপ্ন নগরীতে বাংলাদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর মধ্যে প্রথম শীর্ষ বৈঠক শুরু হয়। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা তাদের মতামত বিনিময় করেছেন এবং বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির, বিশেষ করে উপমহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং টিটোর মধ্যে প্রথম শীর্ষ বৈঠক শুরু হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী জালাল বিয়েদিসের মধ্যে আলোচনা হয়। এছাড়া যুগোস্লাভ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের পৃথকভাবে কয়েক দফা আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী জালাল বিয়েদিসের মধ্যে পরপর কয়েক দফা আলোচনা শেষে এদিন উভয় দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি জাওয়াদুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিওমিতে পৌঁছালে তাকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জানানো হয়। জেটিতে নিজে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান মার্শাল টিটো। বাংলাদেশের নেতার প্রতি বিরল সম্মান প্রদর্শন করেন প্রেসিডেন্ট টিটো। তিনি সাধারণত সরকারি বাসভবনে অভ্যর্থনা জানিয়ে থাকেন। মার্শাল টিটো জেটিতে এসে এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রপ্রধানকে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি যেহেতু কাউকে এভাবে সম্মাননা জানাননি, ফলে এখানকার পর্যবেক্ষক মহল এই অভ্যর্থনাকে অনন্য বলে মনে করছেন। এই দুই মহান নেতার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা। তারা দুজনেই জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সঙ্গী হয়েছেন। তারা দুজনেই তাদের জনগণের মুক্তির জন্য অশেষ দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন। তারা উভয়েই তাদের জনগণের কল্যাণের জন্য আগ্রহী। বেলগ্রেড থেকে বিশেষ বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু ব্রিওমিতে পৌঁছান এবং সেখান থেকে তিনি স্টিমারযোগে জেটিতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য নরনারী বিপুলভাবে হর্ষধ্বনি করে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধুকে সেখানে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
বেলগ্রেডের ফ্রেন্ডশিপ পার্কে বঙ্গবন্ধু একটি শান্তির প্রতীক হিসেবে গাছের চারা রোপণ করেন। আরেক খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ ও যুগোস্লাভিয়ার ভেতরে খুব শিগগিরই একটি কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি সই হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বেতারের খবরে বলা হয়, দু'দেশের মধ্যে একটি কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি সইয়ের কথা এগিয়েছে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুকে যুগোস্লাভিয়ার জনগণের নিবিড় বন্ধুত্ব ও আন্তরিক শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ বেলগ্রেড নগরীর একটি সোনার ফলক উপহার দেওয়া হয়। যুগোস্লাভিয়ার রাজধানীতে ভাইস-প্রেসিডেন্ট একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে এ উপহার দেন। অনুষ্ঠানে কোভাসিয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন।