গঠিত হচ্ছে খতিব কাউন্সিল

খুতবা ‘নিয়ন্ত্রণের’ উদ্যোগ নিচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশজঙ্গিবাদ রোধে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে ইসলামি ফাউন্ডেশন (ইফাবা)।  এরই অংশ হিসেবে শুক্রবার জুমার নামাজের আগে মুসল্লিদের উদ্দেশে দেওয়া খতিবের বক্তব্য বা খুতবা কিভাবে দিতে হবে, খুতবার ভাষা কী হবে—এ নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টিকে কোনও কোনও আলেম ‘খুতবা নিয়ন্ত্রণের’ উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন। এদিকে, খতিবদের সংগঠিত করতে ইফাবা একটি খতিব কাউন্সিল গঠনেরও উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে এ সব তথ্য জানা গেছে।
ইফাবা সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ রোধে সরকারের নির্দেশনার অংশ হিসেবেই শুক্রবারের জুমার নামাজের আগে আরবি ভাষায়  খুতবা দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে সারা দেশে ২টি বিভাগীয় সম্মেলনের মাধ্যমে খতিবদের কাছে এ ধরনের নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বাকি আরও ৫টি বিভাগীয় পর্যায়ে এবং এরপর জেলাপর্যায়ে ইমামদের কাছে এ নির্দেশনা দেওয়া হবে।
ইফাবার মহা-পরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেন, এটা কোনও নিয়ন্ত্রণ নয়। নিয়ন্ত্রণ বলা যাবে না। যেহেতু ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে প্রতিষ্ঠিত, সে কারণে জুমার নামাজের খুতবা যেন ইসলামি পদ্ধতিতে হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখছে। মূলত জঙ্গিবাদ নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতেই এ ধরনের উদ্যোগ।

ইফাবা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ ডিসেম্বর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির উদ্যোগে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কর্মশালায় সাতটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ‘খুতবার বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও আলোচনা’ তৈরিরও সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে কোনও রূপরেখা সারাদেশে ইমামদের কাছে না গেলেও ইফাবার অনুষ্ঠানগুলোয় সামীম মোহাম্মদ আফজাল এ বিষয়ে বক্তব্য রাখছেন।

বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শাখায় যোগাযোগ করেও খুতবার বিষয়ে কোনও নির্দেশনার কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। তবে, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক মুহাম্মদ তাহের হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা বিভাগীয় পর্যায়ে কাজ করছি। এর বেশি কিছু ডিজি ছাড়া বলা যাবে না।

পরে জানতে চাইলে সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, কোনও লিখিত নির্দেশনা নয়, বরং খতিব সাহেবরা কিভাবে মানুষকে দ্বীনের পথে ডাকবেন, কিভাবে জঙ্গিবাদ বিষয়ে মুসল্লিদের সচেতন করবেন, এ নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। সারাদেশের সম্মেলনগুলোয়ও এ নিয়ে আলোকপাত করছি।  তিনি আরও জানান, খুতবা আরবিতেই দিতে হবে। তাদের আরবিতে খুতবা লিখতে ও পড়তে উদ্বুদ্ধ করছি আমরা। মসজিদে কোনও রাজনৈতিক আলাপ করা যাবে না। এটা মেনডেটরি। অবশ্যই আরবিতেই দিতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নিয়ম জেনে লাভ নেই, এই উপমহাদেশে ইসলামের শুরু থেকে আরবিতেই খুতবা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।

সামীম মোহাম্মদ আফজাল আরও বলেন, জুমার নামাজ দু-রাকাত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে খুতবার মর্যাদার কারণে। এ কারণে সেটি কোরআন ও হাদিসের আলোকে আরবিতেই দিতে হবে। তবে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে খুতবার আগে এর সারমর্ম বাংলায় বলতে পারেন। সামাজিক সমস্যাবলিও থাকতে পারে। তবে অবশ্যই রাজনৈতিক কোনও কিছু থাকবে না।

এটি নিয়ম কি না,  কোনও মসজিদে এই নিয়ম মানা না হলে ইফাবা কোনও ব্যবস্থা নেবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছি। প্রেসার দিয়ে নয়, আইন দিয়ে নয়। আমাদের কাজ তো প্রেসারক্রিয়েট করা নয়।

ইফাবার খুতবা-বিষয়ক নির্দেশনা এখনও বিস্তার লাভ করেনি। বৃহস্পতিবার লালবাগ, আজিমপুর, উত্তরা, বনশ্রী, হবিগঞ্জ, সিলেটসহ কয়েকটি এলাকার খতিবদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

উত্তরা ১ নং সেক্টর জামে মসজিদের খতিব মুফতি লুৎফুর রহমান জানান, তার কাছে বা তার মসজিদের কমিটির কাছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোনও নির্দেশনা এখনও যায়নি। একই তথ্য জানান লালবাগের একটি মসজিদের খতিব মাওলানা আনছারুল হক ইমরানও। মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মামুনও জানান, তার মসজিদে ইফাবার কোনও নির্দেশনা যায়নি।

এ নিয়ে জানতে চাইলে সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, রাজধানীতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছি। এখন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করছি। ধীরে-ধীরে সারাদেশে আহ্বান ছড়িয়ে যাবে।

ইফাবা সূত্রে জানা গেছে, খুতবা আরবিতে দিতে আলেমদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ইফাবা। গত বছরের শেষ মাসে এই প্রতিযোগিতায় আসা নির্বাচিত ৫২ টি খুতবা নিয়ে একটি খুতবাগ্রন্থ প্রকাশ করা হবে। গ্রন্থটি সারাদেশের মসজিদে পাঠানো হবে।

সরকারিভাবে খতিব কাউন্সিলের উদ্যোগ

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সারাদেশের খতিবদের সাংগঠনিকভাবে এক মঞ্চে আনতে জাতীয়ভাবে খতিব কাউন্সিলের উদ্যোগ নিচ্ছে। এ কাউন্সিল আরবি ভাষায় খুতবা দেওয়াসহ নানা কাজে গতিশীলতা আনেতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ইফাবা ডিজি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, খতিবরা তো মসজিদ নিয়ন্ত্রণ করেন। মুসল্লিদের প্রতি তাদের প্রভাব কাজ করে। এ কারণে আমরা খতিবদের সাংগঠনিক রূপ দিতে চাচ্ছি। খতিব কাউন্সিলের কাজ হবে সারাদেশের খতিবরা কাউন্সিলের অধীনে কোরআন ও হাদিসের আলোকে দ্বীনের খেদমত করা। মসজিদে রাজনৈতিক বক্তৃতা বন্ধে এই কাউন্সিল অনেকটাই কার্যকরি হবে বলেও প্রত্যাশা করেন সামীম মোহাম্মদ আফজাল।

তবে, এই কাউন্সিল গঠনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়নি। ইফাবার বর্তমান সূচি শেষ হলেই নতুন এই কার্যক্রমটি শুরু হবে বলে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

আবেদন সৃষ্টি হবে না: সোলাকিয়ার খতিব  

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নেওয়া খুতবা নিয়ন্ত্রণ ও খতিব কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি আলেমদের মধ্যে আবেদন তৈরি করতে ব্যর্থ হবে বলে মনে করেন সোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরিদউদ্দীন মাসঊদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, সাধারণত বাংলাদেশের আলেমরা আরবিতেই খুতবা দিয়ে থাকেন। এটা তো নিয়মের কিছু নয়। নিয়ন্ত্রণেরও কিছু নয়। আহনাফ ও আহলে সুন্নাত মতাদর্শীরা তো আরবিতেই খুতবা দেন। এতে দ্বিমত করে সালাফি ও এদেশের জামায়াতে ইসলামী। মাতৃভাষায়ও খুতবা দেওয়ার বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েল আছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক এই পরিচালক মাওলানা ফরিদউদ্দীন আরও বলেন, তবে আরবিতেই দিতে হবে—এমন শর্ত আরোপ করা ঠিক নয়। এটা নিয়ে সমস্যা তৈরি হবে। এখন কী মনে করে সামীম সাহেব এটাকে নিয়ম করতে গেলেন, জানি না। আমি তো কিছু বললেই মনে করেন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার চাহিদা আছে। কিন্তু এটা সত্য নয় বলেই এসব বিষয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আলেমদের কাছে উনার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, এটা উনি নিজেও জানেন।

মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসঊদ বলেন, এই নিয়ম আবেদন তৈরি করতে পারবে না। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন হয়তো খতিব কাউন্সিলে অনেকে যারা চাকরি করেন, তারা সম্পৃক্ত হতে পারেন। তিনি না থাকলে এসব কার্যক্রম আস্থাকুঁড়ে পড়বে। 

/এমএনএইচ/