বাংলাদেশকে জাতিসংঘের বাইরে রাখার অধিকার কোনও শক্তির নেই: বঙ্গবন্ধু

বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বরের ঘটনা।)

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষ শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশকে জাতিসংঘের বাইরে রাখার অধিকার বিশ্বের কোনও শক্তির নেই।’ আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের পর এই দিন (১০ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু তাঁর সফর অভিজ্ঞতার বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম সংবর্ধনা জানান ও মাল্যভূষিত করেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন।

বাংলাদেশ বিমানের ৭০৭ বোয়িংয়ে প্রধানমন্ত্রী আলজিয়ার্স থেকে ঢাকা পৌঁছেন। একইসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন, মন্ত্রী পরিষদের সাবেক সদস্য শামসুল হক এমপি ও পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সম্মেলনে যোগদান শেষে ফিরে আসার পর বিমান বাহিনী প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার মোহম্মদ উল্লাহ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

দৈনিক বাংলা, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩নিপীড়িত মানুষ ঐক্যবদ্ধ

অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে আলজিয়ার্স সম্মেলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই প্রথম বিশ্বের এত বেশি সংখ্যক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সমাবেশ ঘটলো। দুনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী নেতারা বিশ্বের সমস্যাবলি, বিশেষ করে জোটনিরপেক্ষ নীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্ব শান্তির জন্য জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন কার্যকর সুপারিশও ঘোষণা করেছে। দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে বিশেষভাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে সম্মেলনে নেতারা সরব হয়েছেন।’ সেদিক থেকে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন একটি বিরাট সাফল্য বলে তিনি মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী জানান, শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত নেতাদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে বিশ্বের গরিব মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার ডাক দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে জনকল্যাণে সম্পদের ব্যবহার-সাপেক্ষে আমরা যদি বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করতে পারি, তবে আমরা মানুষের কল্যাণ ও তাদের বেঁচে থাকার জন্য কার্যকর কিছু করতে পারবো।’

ডেইলি অবজারভার, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শীর্ষ সম্মেলনে সুস্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে যে, বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা তাদের পাশে থাকবো। আমরা আজ নির্যাতিত ও নির্যাতনকারী—এই দুই ভাগে বিভক্ত। আমরা জনগণের সঙ্গে আছি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আলজিয়ার্সে আমি একাধিক নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেছি। তারা সকলে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশ বিশ্ব সংস্থার সদস্যপদ লাভের প্রাথমিক বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হবে।’

জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ

জোট নিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে নতুনভাবে আস্থা জ্ঞাপনের মাধ্যমে চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন সমাপ্ত হয়। সম্মেলনে রাজনৈতিক ঘোষণায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে যেকোনও দেশ তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু তা বাংলাদেশের সঙ্গে সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থ উপেক্ষা করার নামান্তর মাত্র বলে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে রাজনৈতিক কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। এরপরও এর বিরুদ্ধে কোনও দেশ ভেটো দিতে পারে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে  প্রধানমন্ত্রী তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি বৃহৎ দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করবে কিনা তা তারা সিদ্ধান্ত নেবে। এ ব্যাপারে চীনকে আমাদের কিছু বলার নেই।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সদস্যপদ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এখন বিশ্ব সংস্থার সদস্য হতে না পারার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনও ত্রুটি নেই।’