দুর্গতদের মাঝে বঙ্গবন্ধু

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১৩ ডিসেম্বরের ঘটনা।)

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালবিলম্ব না করে ব্যাপকভাবে শীতকালীন ফসল উৎপাদনের জন্য দুর্গতদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। ১৯৭৩ সালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা ফসল তুলে পুষিয়ে নেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি তিনি কঠোর ও একনিষ্ঠ পরিশ্রম করার আহ্বান জানান। এই দিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার কয়েকটি দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। এসব এলাকায় বিপুল জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারাক্রান্ত এক আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসে আমাদের খাবারের এক বিরাট অংশ নিয়ে গেছে।’ তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ও সামগ্রিক জলোচ্ছ্বাস যদি আর এক মাস পরে আসতো, তাহলে এমন বেশুমার ক্ষয়ক্ষতি আমাদের হতো না। কিন্তু আল্লাহ চাইলে আমরা আরও অনেক বেশি ফসল পেতে পারি।’ তবে সে জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, সৎ হতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকার জনগণের জন্য ত্রাণ ও সাহায্য তৎপরতা জোরদারের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘যারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রকৃত গরিব এবং তাদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু যারা ক্ষতিগ্রস্ত নয়, সাহায্য পাওয়ার যারা অনুপযুক্ত, তাদের কাছে যেন কোনোভাবেই তা না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সমুদ্র থেকে আগত জলোচ্ছ্বাসের আক্রমণ ও বিপর্যয় থেকে উপকূল অঞ্চলের জনগণকে রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হবে।’

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩

এ অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণ করে জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে জনগণকে রক্ষা করা যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এজন্য প্রয়োজন হবে জনগণের কঠোর পরিশ্রম। যেহেতু প্রকৃতিকে প্রতিরোধ করার যন্ত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হইনি, আমরা প্রকৃতির এই হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যা করতে পারি, তা হচ্ছে সমুদ্র উপকূলবর্তী নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে পারি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সম্মিলিতভাবে এ ধরনের নির্মাণ প্রকল্প তৈরি করতে হবে। এজন্য টাকার কোনও অভাব হবে না। আর সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন হবে, তা হচ্ছে জনগণের কঠোর পরিশ্রম।’

ঘূর্ণিঝড় দুর্গত যেসব এলাকায় প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন সবখানেই জনসাধারণ তাঁকে জানিয়েছে যে, তারা রিলিফ চান না। তারা চান কৃষি সাজ-সরঞ্জাম। বঙ্গবন্ধু তাদের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি জানি, আপনারা রিলিফ চান না। চাষাবাদের সরঞ্জাম চান।’ তিনি বলেন, দুর্গত এলাকায় তিনি চেষ্টা করবেন তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে। বঙ্গবন্ধু বলেন,  তিনি তাদের দুঃখ কষ্ট লাঘবের জন্য চেষ্টা করে যাবেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বন্ধু দেশগুলো থেকে দুইশ’ কোটি টাকা মূল্যের সাহায্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও জাতি দীর্ঘদিনের সাহায্যের ওপর বাঁচতে পারে না।’ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য দেশবাসীকে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ডেইলি অবজারভার, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘যেসব লোক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে, তাদের প্রতি বারবার আবেদন-নিবেদন করলেও এরা জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সুযোগ নিচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধু এসব সমাজবিরোধীকে খুঁজে বের করার জন্য, তাদের সকল তৎপরতা নির্মূল করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। চরফ্যাশনে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী সকল সরকারি কর্মচারীকে আত্মোৎসর্গের মনোভাব নিয়ে জনগণের সেবা করে যেতে বলেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, তারা আজ আর কোনও বিদেশি সরকারের বেতনভুক কর্মচারী নন। পাকিস্তানি শাসনামলে ১৯৭০ সালের  ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানের শাসকবর্গ কোনোদিন এদেশের জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিদেশ থেকে যেসব ত্রাণ-সাহায্য আসতো, তা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে চলে যেতো। কিন্তু সেই দিন আর নেই। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম। এ সরকার জনগণের সরকার। সেই কারণেই বর্তমান সরকার সকল শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে। দুর্গতদের সাহায্য করতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ত্রাণসামগ্রী আনা হয়েছে।’