আত্মসমর্পণ নিয়ে নিয়াজি ও রাও ফরমান আলীর মতভেদ চলছিল

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে একে একে মুক্ত হচ্ছিল এলাকা, পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটছিল নানা অঞ্চল থেকে। সেসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কী করেছিল? তারা কি পালাবার পথ খুঁজছিল? এ প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ জবাব পাওয়া যাবে এমন নথি খুব বেশি নেই। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, সেসময় পাকিস্তানি সেনারা পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। চোখের সামনে পরাজয় স্পষ্ট হলেও স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছিল ওদের।

প্রথম অবস্থায় বেশ কয়েকটি জায়গায় আত্মসমর্পণ করলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ওই সময় সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসাররা কী করছিল? আত্মসমর্পণের দিনকয়েক আগে থেকে আত্মসমর্পণের প্রসঙ্গ নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে। সেসময় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিয়াজি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করতে চান, আর রাও ফরমান আলী বলছেন—আত্মসমর্পণ করা উচিত।

সারাদেশে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তান বাহিনী যখন পিছু হটছে, তখন রাজধানী ঢাকা ঘেরাও হয়ে গেছে। দিশেহারা হয়ে পথ খুঁজছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকাস্থ হাইকমান্ড। তাদের ইতস্তত পদচারণা, বিক্ষিপ্ত সংলাপ—সব মিলিয়ে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছিল যা দেখে মনে হয় অন্তত আর কেউ না হোক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী স্বস্তিতে ছিলেন না। বেসামরিক প্রশাসনের সর্বোচ্চ দায়িত্বে নিযুক্ত রাও ফরমান আলী অনেক ঘটনার নায়ক এবং বহু হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনাকারী। জানা যায়, রাজাকার বাহিনী তৈরির পরিকল্পনাকারীও তিনি। তাদের আত্মসমর্পণের পর কতগুলো দলিল পাওয়া যায়। সেসব থেকে তার মানসিকতা সহজেই অনুমান করা যায়।

আত্মসমর্পণের পর সংশ্লিষ্ট দলিল পাওয়া যায় তৎকালীন গভর্নর হাউসে ছড়ানো কাগজপত্রের মধ্যে। দলিলগুলোতে এমন বক্তব্য লেখা রয়েছে যার অধিকাংশ অসম্পূর্ণ হলেও এগুলো থেকে তৎকালীন অবস্থা আঁচ করা যায়। যে দলিল পাওয়া যায়, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতিতে মার্কিনবিরোধিতার সম্ভাবনাও লক্ষ্য করা যায়। এক জায়গায় লেখা ছিল—ব্যাংককের টিকিটের কথা। সেটা থেকে বোঝা যায়, তারা ব্যাংককে পালিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবছিল।

দুজনের নাম লেখা আছে তার একটি হচ্ছে ডব্লিউ ভেসপিক ও অপরটি মিস্টার হাইট। এদের নামের মাঝে দুটো ইংরেজি শব্দ লেখা। যার একটির অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই দুজনকে মার্কিন নাগরিক ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি বলে অনুমান করা হয়। অন্য যেসব কথা লেখা রয়েছে সেগুলো তৎকালীন পরিস্থিতির কিছু চিত্র দেয়। যেমন লেখা ছিল রাতে তল্লাশিতে থাকা পুলিশ বাহিনীর চলাফেরার কথা ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ছুটি দেওয়ার কথা।

উদ্ধারকৃত একটি দলিলে লেখা রয়েছে, ৫০ হাজার সেনার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত। এ দিয়ে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করা দরকার, সিদ্ধান্ত হতে পারে, তারা আমাকে শেষ করে দেবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত একজন পরাজিত সেনাপতির স্বাভাবিক মানসিকতা। আবার অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তারা আমাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্তকেই পুরোপুরি সত্য বলা যায় না।

এক নম্বর দলিলের সর্বশেষ মন্তব্যে লেখা আছে, ‘সেনাবাহিনীর হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনও সার্টিফিকেট আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’ যার অর্থ দাঁড়ায়—পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব পুলিশ এখানে এসেছিল তারা স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটিতে আছে। আর পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে রাজি নয়। এদের ঠেকাতে প্রয়োজন সেনাবাহিনীর হাসপাতালের সার্টিফিকেট। কেন এসব লেখা হয়েছিল তা যদি রাও ফরমান আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো তা হলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যেতো।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, শেষ মুহূর্তে তারা এলাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় দলিলগুলোর ছিন্নভিন্ন কিছু অংশ মিলেছিল বলেই অনুমান করা যায়। তাদের সে সময়ের মানসিকতাও কিছুটা টের পাওয়া যায়। যখন একজন মানুষ তার ডায়েরিতে বিভিন্ন কিছু টুকছে তখন সে নিজের সঙ্গে আলাপ চালায়। পরে এই কাগজগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে যদি বসার সুযোগ তৈরি করা যেতো তাহলে তারাই ব্যাখ্যা করতো এসব সাংকেতিক লেখার অর্থ কী।