১৯৭২ এর ২৪ মে পড়েছিল ১১ জৈষ্ঠ্য। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। সেদিন গণভবন থেকে কাজ সেরে আড়াইটায় বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাড়িতে আসেন। বাড়ি গিয়ে তিনি বুকশেলফ থেকে বের করেন নজরুলের কাব্যগ্রন্থ সঞ্চিতা। আবৃতি করেন বিদ্রোহী কবিতা-‘মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হবো শান্ত।’ আবৃত্তি করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন। তার বাড়ি থেকে ২৮ নম্বর রোডে কবির বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত আওড়ালেন কবিতার চরণ।
কবি দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে। কিন্তু পরে ভারত সরকার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সম্মান, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার বাঁধনে ধরা দেন তিনি। তিনি সে সময় রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ছিলেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধু ২৮ নম্বর রোডে কবির বাড়ির গেট ঠেলে ঢুকলেন। কবিকে যেখানে রাখা হয়েছে সে কক্ষে গিয়ে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পরিয়ে দিলেন পুষ্পমাল্য। বেগম মুজিব নিজের হাতে তুলে দেন অতি যত্নে বানানো ফুলের তোড়া। কবির মাথায় ও শরীরে হাত বুলিয়ে দেন। কবি নির্বাক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। দৈনিক বাংলার পরের দিনের পত্রিকায় পাওয়া যায় ছবিসহ বিস্তারিত।
কবির সেই মায়া চোখের ভাষা শব্দ আকারে গণমাধ্যমে আসে পুত্রবধূ উমাকাজীর মুখ দিয়ে ১৯৭৩ সালে, এক বছর পরে। ১৯৭৩ এর ২৫ মে পত্রিকার খবরে জানা যায়, কবি তখন অনেকটা সুস্থ। একা একা বাড়ির মধ্যে পায়চারী করতে পারেন। কবির জন্য বঙ্গবন্ধু বাড়ি, গাড়ি, মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আছে সার্বক্ষণিক একজন ব্রাদার, একজন আয়া, রান্নার লোক। কবির এই জীবনযাপনে তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। তিনি সে সময় একটু একটু অনুভূতি প্রকাশও করেন।
বঙ্গবন্ধু সবসময় দুঃখ করে বলতেন, বাংলা সাহিত্যের এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোনও আলোচনা হলো না। ১৯৭২ এর জন্মদিনে এক বাণীতে তিনি বলেন, ‘কবি নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মার, বাঙালির স্বাধীন সত্তার রূপকার।’ পবিত্র মাটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের চারণ কবি বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম দিবস পালিত হচ্ছে সেটিকে আনন্দ ও গর্বের বিষয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “শুধু বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, শান্তি নিকুঞ্জ কবি বাংলার অমৃত কন্ঠ ‘বুলবুল’। দুঃখের বিষয়, বাংলা সাহিত্যের এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোনও আলোচনা হলো না। বাংলার নিভৃত অঞ্চলে কবির বিস্মৃতপ্রায় যেসব রত্ন আছে, তা পুনরুদ্ধারের যেকোনও উদ্যোগ প্রশংসাযোগ্য।” বাণীতে বঙ্গবন্ধু কবির সৃষ্টি পুনর্মূল্যায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশের বিদগ্ধ সমাজকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান।