‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’

আজ বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। শেখ হাসিনা সরকারের তৃতীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল বিকালে সংসদে সরকারের আগামী একবছরের হিসাব-নিকাশ সংবলিত বাজেট উপস্থাপন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এর আগে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে নতুন বছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হবে। বেলা একটায় মন্ত্রিসভার এ বিশেষ বৈঠক জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।

জাতীয় সংসদ ভবন সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে নতুন বাজেট অনুমোদন পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তাৎক্ষণিক নতুন বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য সম্মতি সূচক অনুমোদন দেবেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও আগামীকাল সংসদ ভবনে রাষ্ট্রপতির দফতরে অফিস করবেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এবারের বাজেট হবে করোনাকে মোকাবিলা করে চলতি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে রুখে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট। এবারের বাজেটকে সামনে রেখে রয়েছে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সরকারকে বাজেট প্রস্তাব করতে হচ্ছে। বাজেট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরাবরের মতোই এবারও চলমান বৈশ্বিক সংকটকে মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জনসহ মূল বাজেট বাস্তবায়নই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বময় করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠে এবার চলমান রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং এটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া ডলার সংকট মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে সরকারের নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। এবার দেশের ১৬ কোটির অধিক জনগোষ্ঠীর জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট তৈরি করছেন শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি মোট জিডিপির ১৫  দশমিক ৩ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে করোনার কারণে গত দুই বছরে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কর্মহীন এসব মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা, সরকারের খাদ্য মজুত বাড়িয়ে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। রাজস্ব আয় বাড়ানো, চলমান বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ, বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানো, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো ইত্যাদি হবে সরকারের এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য।   

সূত্র জানায়, বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির এক ধরনের উদ্যোগ থাকছে বাজেটে। গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কৃষি ও জ্বালানি খাতকে। বৈশ্বিক কারণে সারের দাম বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। ৩৬ টাকা কেজি দরের সার বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯৬ টাকায়। ৯৬ টাকা দরে কিনে এনে প্রতিকেজি সার সরকারকে বিক্রি করতে হবে ৩৬ টাকা দরে। ফলে কৃষিখাতের ভর্তুকি ১২ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা যোগান দিতে হবে। ফলে আগামীতে বাড়বে কৃষি খাতের ভর্তুকির পরিমাণও। বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে যেন কৃষি খাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি না হলে খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়বে। বাড়বে চালের উৎপাদন খরচ। ফলে কৃষিখাতের ভর্তুকি না বাড়ানোর কোনও বিকল্প নাই।

করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার পর্যায়ে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করেছে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করা হচ্ছে, এটি দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে (বৈদেশিক অনুদানসহ) ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এনবিআর বহির্ভূত কর ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর বহির্ভূত আয় বাবদ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

জানা গেছে, গত দুবছর করোনার কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে ছিল। উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করে স্বাস্থ্য খাতের অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। তবে এখন কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকটে পড়েছে রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে। এ জন্য সরকার আগামী বছর উন্নয়ন খাতে ব্যয় বেশি করার পরিকল্পনা নিয়েও সাবধানে এগিয়ে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শতাধিক পণ্যে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করেছে। আগামীকালের বাজেটে আরও কর আরোপ করা হবে। নতুন বাজেটে উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে ৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় করা হবে ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আগামী অর্থবছরের এডিপিতে কাটছাঁট করা হবে না। কৃচ্ছ্রতা সাধনের লক্ষ্যে এডিবির অর্থ খরচের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না। কারণ এডিপির প্রবৃদ্ধি না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। এটি না হলে মানুষের আয় বাড়বে না। প্রসঙ্গত, করোনাকালীন এডিপির ২৫ শতাংশ ব্যয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল অর্থ বিভাগ। অর্থ সাশ্রয় করে স্বাস্থ্য খাতে স্থানান্তরের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। একইভাবে পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, বৈদ্যুতিকসামগ্রী, ইলেকট্রো মেকানিক্যাল পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় খুব বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব নেই বাজেটে। আসছে বাজেটে এডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপির আকার ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের জিডিপির আকার বাড়ানো হচ্ছে। প্রাক্কলিত আকার ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।