জঙ্গিদের সুপথে ফেরানো ও সচেতনতা কার্যক্রম কতদূর?

২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর নড়েচড়ে বসেছিল সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিদের সুপথে ফেরানোর জন্য নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন কার্যক্রম। স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসায় চালু করা হয়েছিল সচেতনতা কার্যক্রম। কিন্তু ছয় বছরের মাথায় সেসব কার্যক্রম চলছে একেবারেই ঢিমেতালে। একমাত্র জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি জেলায় জেলায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা চালু রেখেছে। তবে জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণকারী বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আপাতদৃষ্টিতে সহিংস তৎপরতা দেখা না গেলেও সমাজে উগ্রপন্থীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। সামাজিক শক্তিকে সক্রিয় করতে না পারলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তি বা জঙ্গি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো যাবে না। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বাইরে থাকা জঙ্গি ও জঙ্গি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন বা সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ৪২টি জেলায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে। একইসঙ্গে কারাগারে থাকা জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রমও হাতে নেওয়া হয়েছে।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জঙ্গিদের ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন কার্যক্রম আমরা নিয়মিত করে যাচ্ছি। চলতি বছরেও আমরা ১২টি জেলায় মতবিনিময় সভা করেছি। সর্বশেষ শরীয়তপুর জেলায় জনসচেতনতামূলক একটি প্রোগ্রাম করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের লোয়েস্ট ইউনিট তথা ওয়ার্ড মেম্বারসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে আমাদের কার্যক্রমে যুক্ত করেছি।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা কারাগারেও ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন প্রোগ্রাম চালু করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ থেকে অনুমতি পেয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন বিশেষজ্ঞ নিয়োগের কাজ চলছে। বিশেষ করে সাইকোলজিস্ট, ইসলামিক অর্থাৎ ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিসহ সমাজ বিজ্ঞানীদের নিয়ে কারাগারে থাকা জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে এই কার্যক্রম চালু করা হবে।

জঙ্গিবাদ নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকারীরা বলছেন, জঙ্গিবাদ দমনে হার্ড অ্যাপ্রোচ বা আভিযানিক কার্যক্রমের পাশাপাশি জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনা, সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা সমান্তরালভাবে করা উচিৎ। কারণ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ও জঙ্গি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাকে সঠিক পথে আনতে না পারলে কোনওভাবেই দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাবে না। বাইরে জনসচেতনতা তৈরি করার পাশাপাশি কারাগারের ভেতরে থাকা জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চালু করতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কারাসূত্র বলছে, বর্তমানে দেশের ৬৮টি কারাগারে মোট  ২ হাজার ৩শ জঙ্গি সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে চারটি কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে ৩৬৬ জন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে রয়েছে ১৫ জন জঙ্গি সদস্য, কাশিমপুর-১ এ ৩২ জন, কাশিমপুর-২ এ ৫৪ জন, কাশিমপুর-৩ এ ১০ জন ও কাশিমপুর-৪ অর্থাৎ হাই সিকিউরিটি কারাগারে রয়েছে ২৫৫ জন জঙ্গি সদস্য। এসব জঙ্গি সদস্যদের মধ্যে শতাধিক জঙ্গির বিচার শেষে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বলছেন, কারাগারে থাকা জঙ্গিদের ওপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। কারণ মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা জঙ্গিরা নিজেরা সুসংগঠিত হয়ে বাইরে বিভিন্ন নির্দেশনা পাঠিয়ে সংগঠনকে সচল করার চেষ্টা করছে। এছাড়া কারাগারে জঙ্গিদের ইন্টারনেটসহ মোবাইল ব্যবহারের তথ্যও পাওয়া যায়। একাধিক শীর্ষ জঙ্গি কারাগারে বসেই হামলার পরিকল্পনাও করেছিল।

কারা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা নিজেরা যতদূর পারছেন কারাবন্দি জঙ্গিদের বিশেষ মোটিভেশন দেওয়ার চেষ্টা করেন। অসাধু কিছু কারারক্ষীর মাধ্যমে তারা হয়তো বিশেষ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিষয়গুলো সবসময় নজরদারি করা হয়। কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু দেশের ৬৮টি কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দিগুণ বন্দি থাকায় জঙ্গিদের আইসোলেশনে রাখা বেশিরভাগ সময়ই সম্ভব হয় না। এছাড়া কারাগারে জনবলও কম। সারাদেশের ৬৮টি কারাগার চলছে মাত্র ১২ হাজার সদস্য দিয়ে। জনবল ও আয়তন বাড়ানোর মাধ্যমে কারা কর্মকর্তাদের আরও বেশি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করতে পারলে জঙ্গি সদস্যসহ সব ধরণের অপরাধীদের সুপথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

কারা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, কারাগারের অভ্যন্তরে জঙ্গিসহ সাধারণ বন্দিদের ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনও কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। তবে কারাগারে সাইকোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। একইসঙ্গে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিভিন্ন সংস্থা ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে কারা কর্মকর্তাদের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা বিভাগীয় কারা উপ-মহাপরিদর্শক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা জঙ্গিদের ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন করার চেষ্টা করি। আমাদের জেল সুপারসহ অন্যান্য কারা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন কার্যক্রমও চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।

সচেতনতা কার্যক্রমেও সমন্বয় নেই

বাংলাদেশে বহু বছর ধরে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমকে অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা মনে করা হলেও তা প্রতিরোধের কার্যক্রমে এখনো সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সিটিটিসির পাশাপাশি এন্টি টেরোরিজম ইউনিটও মাঝে মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কোনওভাবেই পর্যাপ্ত নয়। সরকারের শিক্ষা, যুব উন্নয়ন, ধর্ম, আইসিটি ইত্যাদি বিভাগগুলোকে একযোগে এই সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনের জন্য জাতীয় কোনও কৌশলপত্র তৈরি হয়নি। একেক সংস্থা একেকরকম ভাবে জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করছেন। জঙ্গিবাদ বা সহিংস উগ্রবাদ দমনে জাতীয়ভাবে কার্যকর কোনও নীতি নির্ধারণী বডি বা সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা হয়নি। যারা পুরো বিষয়টি সমন্বয় করতে পারতেন।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারের মহাপরিকল্পনা নেওয়া উচিত ছিল। হোলি আর্টিজান হামলার পর কিছু কার্যক্রম দেখা গেলেও এখন আর সেসব কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছাড়াও রুট লেভেলে কোনও জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচার-প্রচারণা নেই বললেই চলে। এছাড়া জঙ্গিবাদ দমনে মূল বিষয় হলো সামাজিক শক্তিকে কাজে লাগানো। কিন্তু অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে সামাজিক শক্তিও দাঁড়াচ্ছে না। এভাবে আসলে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়।