বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হলেও রায় কার্যকর হয়নি

দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলেও সাজা কার্যকর করা যায়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নকারী আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির রায় দিলেও তারা প্রবাসে পলাতক হওয়ায় রায় বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। একাত্তরে ১৭ জন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে সাজা হয়েছে মাত্র দুই জনের।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। তবে ওই হত্যার মূল খলনায়ক ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। এ নৃশংস অপরাধের জন্য তারা ফাঁসির যোগ্য। তাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।’

রায়ে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও  রক্ত ঝরাচ্ছে। আমরা আরও বিশ্বাস করি, গত চার দশকে মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার করতে না পারায় জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত। এ লজ্জা আমাদের ক্ষতকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ বাঙালি জাতিকে চিরদিন নিদারুণ যন্ত্রণাই দিয়ে যাবে।’

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। যুদ্ধে জয়ী হলেও বাঙালি যেন আর কোনোদিন বিশ্বসভায় শিক্ষা, মননে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের এই নীল নকশাটি বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের আগ মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরকে বেছে নেয়। তারা রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তা নিয়ে বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য আলোকিত মানুষদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে রায়ের বাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলা, মিরপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে একে একে হাত-পা-চোখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে।

বিচার কতভাবে আটকানোর চেষ্টা হয়েছিল
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠিত হয় বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭২। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত ও বিচারেরও প্রথম দাবি করা হয় ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ। শহীদুল্লাহ কায়সার, ডা. আলীম চৌধুরী, জহির রায়হান, আজহারুল হক প্রমুখ শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যার তদন্ত দাবি করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করা হয়। এরপর সমাবেশটি মিছিলসহ পুরনো গণভবনে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে। ১৮ মার্চ দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়— বঙ্গবন্ধু শহীদ পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শহীদ জহির রায়হানের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে বলেন, তিনি হত্যা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তার সরকার স্বাধীনতার পর দালাল আইনে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু আইনি জটিলতার দোহাই দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার তদন্ত নষ্ট করে দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে বলা হয়, স্বাধীনতার ২৬ বছর পর আওয়ামী লীগ শাসনামলে ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় প্রথম মামলা করা হয়। ওই মামলায় আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে আসামি করা হয়। মামলাটি করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদের বোন ফরিদা বানু। সেসময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়-স্বজনসহ ৪০ জনের সাক্ষ্য-প্রমাণও সংগ্রহ করা হয়। পরে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা করার অনুমতি চেয়ে পুরো প্রক্রিয়া জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০০২ সালের ২০ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানো হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছিল ২০০২ সালে। তখন জানানো হয়েছিল, চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার পর ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা করা হবে।

২০১০-এ এসে বিচার পথ পেলো
২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের বিচার, আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল দুই আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। এরপর ২ মে আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। তাদের পাওয়া না যাওয়ায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়। তারপরও আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২৪ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের দুই বদর নেতার বিচার শুরু হয়।

রায় পেলেও বিচার কার্যকর না হওয়া প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার শিরোমণিদের বিচার হলেও রাজাকার, আলবদর ইত্যাদি ঘাতক বাহিনী এবং তাদের স্রষ্টা জামায়াতে ইসলামী এবং সহযোগী সংগঠনের বিচার হয়নি। অধিকাংশ শহীদ পরিবার তাদের আপনজনের ঘাতকদের ব্যক্তিগত পরিচয় জানেন না, তারা চেনেন সংগঠন। ১৯৭১-এ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা ছিল জামায়াতে ইসলামীর দলীয় সিদ্ধান্ত, যা ঘাতক বাহিনীর সদস্যরা কার্যকর করেছে। ’৭১-এর গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকে ধর্মের নামে বৈধতা দেওয়ার জন্য জামায়াতের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, এরা ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের দালাল’,  এরা ‘ইসলামের দুশমন’।

যাদের ঋণ শোধ হবে না
আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিন যে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার জন্য অভিযুক্ত হয়— তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকরা হচ্ছেন, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহি, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। শহীদ চিকিৎসকরা হচ্ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. মর্তুজা, বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী ও বিশিষ্ট কার্ডিওলোজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী। শহীদ সাংবাদিকরা হচ্ছেন, দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেন, পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের চিফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সংবাদদাতা ও পিপিআইয়ের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নিজামউদ্দিন আহমেদ, শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা সেলিনা পারভীন এবং দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার।