নির্যাতন রোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে বিদ্যমান আইন সংস্কার, স্বাধীন জাতীয় পর্যবেক্ষণ কাঠামো গঠন এবং বিচার প্রক্রিয়ার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতনের ঘটনা চলতেই থাকবে বলে মনে করেন দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
২৬ জুন (বৃহস্পতিবার) আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস। দিনটি ঘিরে বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলো জোরালোভাবে নির্যাতন প্রতিরোধ ও জবাবদিহিতার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষভাবে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সরকারের কাছে জরুরি আইনগত সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবসে এ বছরের বার্তা স্পষ্ট: নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হলে শুধু আইন নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন এবং একটি কার্যকর ও জবাবদিহিতামূলক বিচারব্যবস্থা। রাষ্ট্রের কাছে জনগণের প্রত্যাশা নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন।
নির্যাতনবিরোধী এই দিবসে ব্লাস্ট এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ নির্যাতনবিরোধী সনদের ঐচ্ছিক প্রোটোকল (ওপিসিএটি) অনুমোদনের আহ্বান জানান। পাশাপাশি "নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩" এবং ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধিসহ সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, বহু নির্যাতনের মামলায় ভুক্তভোগীরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিচার পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। ব্লাস্ট বলছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তারা অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাসমূহ সুষ্ঠু বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
আসক এক বিবৃতিতে বলেছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী অন্তত ১৫টি বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশের তদন্তই হয়নি। ব্লাস্টের জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা ফাহাদ বিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘আমার জানা মতে, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘ নির্যাতনবিরোধী সনদ (ইউএনসিএটি) অনুস্বাক্ষর করলেও এখনও অনুচ্ছেদ ২১ ও ২২ এর জন্য আলাদাভাবে সম্মতিমূলক ঘোষণা দেয়নি এবং অনুচ্ছেদ ২০ পালনে এখনও রাজি হয়নি। একইভাবে, এই সনদের ঐচ্ছিক প্রোটোকল (ওপিসিএটি) অনুমোদনের অভাবে দেশে এখনও কোনও স্বাধীন জাতীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গঠিত হয়নি, যার মাধ্যমে আটকস্থলগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা নিশ্চিত করতে পারত। ওপিসিএটি অনুমোদন হলে হেফাজতে নির্যাতন প্রতিরোধে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক ও জাতীয় কাঠামো গড়ে উঠত। এই অনুচ্ছেদ সমূহ পালনে ঘোষণা ও সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকল অনুমোদন করে বাংলাদেশ চাইলে মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারে।’’
মানবাধিকার গবেষক ও আইনজীবী আয়েশা আক্তার বলেন, “নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে কেবল আইন করলেই হবে না, তা বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বা হেফাজতে মৃত্যু প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।” এদিকে, গুম সংক্রান্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা মোট ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩টি গুমের ঘটনার সত্যতা পেয়েছে।
কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “প্রায় প্রতিটি গুমের ঘটনায় একই রকম প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীদের তুলে নেয়া হয়েছে, সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং মামলা দায়েরের পদ্ধতিও প্রায় অভিন্ন।” তিনি জানান, এসব গুমের ঘটনা পরিকল্পিত এবং শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়েছে। প্রতিটি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। কিছু কিছু ব্যক্তিকে গুম করে ভারতেও আটকে রাখা হয়েছে। এসব ব্যক্তিদের সঙ্গে এমনভাবে নির্যাতন চালানো হতো, যাতে করে তারা এসব ঘটনায় পরবর্তীতে কারও সঙ্গে শেয়ার করতে না পারে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নির্যাতন ও বেআইনি আটক এসব অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাস্তবে ২০১৩ সালের নির্যাতন বিরোধী আইনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ফলে আইনি কাঠামো থাকলেও বিচার পেতে ভোগান্তির শেষ নেই।