বাংলা বানানে ভুলের ছড়াছড়ি

বছরজুড়ে বিলবোর্ড-ব্যানার-ফেস্টুনসহ বিভিন্ন লেখায় বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ভুলের ছড়াছড়ি দেখা যায়। ভাষার মাসে নতুন করে আবারও চোখে পড়ে ভুলের বাহার। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের পোস্টার-ব্যানার-পুষ্পাঞ্জলিতেও ভুল বাংলা বানানের ছড়াছড়ি লক্ষণীয়। এবারের মহান শহীদ দিবসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

শ্রদ্ধাঞ্জলি বানানে ভুল

মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের নেতাকর্মীরা। তারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের পক্ষে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে এসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত ব্যানার ব্যবহার করেন। এই ব্যানারে ভুল বানানে লেখা হয়েছে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ (সঠিক বানান শ্রদ্ধাঞ্জলি)।

শ্রদ্ধাঞ্জলি বানানে ভুল

শুধু শহীদ মিনারে নয়, শহীদ মিনারের বাইরেও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ব্যানার-ফেস্টুনে বানান ভুলের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একজন নেতার একটি ফেস্টুনে ফেব্রুয়ারি বানানটি ভুলভাবে লেখা হয়েছে ‘ফেব্রুয়ারী’।

ভুল বানানে লেখা হয়েছে ’ফেব্রুয়ারী’, আইনজীবী বোঝাতে ’অ্যাড.’ এর পরিবর্তে ‘এড.’ শব্দটিও ভুল

ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি বানান ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ লিখেছে কেরানীগঞ্জ উপজেলা দক্ষিণ বিএনপি।

বিদেশি শব্দের বানানে রাজধানীর বিলবোর্ড-ব্যানারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল দেখা যায়। ফার্মেসি শব্দটি  ‘ফার্মেসী’, লাইব্রেরি বানানটি ‘লাইব্রেরী’ এবং এজেন্সি শব্দটি ভুলভাবে লেখা হয় ‘এজেন্সী’। এমন অনেক বিদেশি শব্দের বানানে ভুল চোখে পড়ার মতো। এমন অনেক ভুল বানানে ছেয়ে আছে রাজধানীর বিভিন্ন সাইনবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন। খোদ বাংলা একাডেমির বানান ভুলভাবে লেখা ছিল ‘একাডেমী’, যদিও তা পরে সংশোধন করা হয়েছে।

ভুল বানানে লেখা হয়েছে ’লাইব্রেরী’

রাজধানীর আব্দুল গণি রোডের প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের বিলবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘প্রশাসনিক আপীল ট্রাইবুনাল’। এখানে ‘আপীল’ ও ‘ট্রাইবুনাল’ বানান দুটি ভুল।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রমিত বানান রীতি অনুযায়ী বানান লেখার নির্দেশনা দিলেও দীর্ঘদিন এই ভুল সংশোধন করা হয়নি।

‘গ্রোসারী’ বানানটি ভুল

বাংলা বানান ভুলের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শোয়াইব জিবরান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানুষ নিজের মায়ের ভাষাকে গুরুত্ব দেয় না, এটি একটি সমস্যা। এছাড়া আমরা নিজেরা অনেক বানান পরিবর্তন করেছি। শহীদ বানান বাংলা একাডেমির অভিধানে শহিদ এবং শহীদ দুটিই রাখা হয়েছিল। যেহেতু শব্দটি বিদেশি, তাই বিদেশি শব্দে সাধারণত হ্রস্ব ই-কার ব্যবহার করা হয়। ঈদ বানানে আগে অভিধানে ঈদ এবং ইদ দুটিই ছিল। এখন শুধু ইদ রাখা হয়েছে।’

এই কবি-সাহিত্যিক যোগ করেন, ‘বাংলা বানান নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা সবাই একমত নন। বাংলা একাডেমির পণ্ডিতদের মধ্যেও ঐকমত্য নেই। তাদের মধ্যে যদি দ্বিমত থাকে, তাহলে সাধারণের ক্ষেত্রেও দ্বিমত তৈরি হবে এবং ভুল হবে।’

’এন্ড’ লেখা হয় ‘অ্যান্ড’ হিসেবে

বাংলা ভাষার এই অধ্যাপক বলেন, ‘প্রতিবর্ণীকরণ নিয়েও একমত না তারা। একমত না হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে বিশৃঙ্খলা তো দেখা দেবেই। আর যারা ভাষা ব্যবহার করছেন তারা বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে যতটা যত্নশীল, বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ততটা যত্নশীল নন।’

অধ্যাপক ড. শোয়াইব জিবরান আরও বলেন, ‘উত্তরণের উপায় হতে পারে— বানান নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। দুই জন কিংবা চার-পাঁচ জন পণ্ডিত নিয়ে কিছু করে ফেললে হবে না। সবাইকে একমত হতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে— বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ না দেওয়া। বাংলা একাডেমি একটি নিয়ম করলো, আবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) আরেকটি নিয়ম করলো, তাতে কিন্তু কাজ হবে না। যদিও এনসিটিবি সেই জায়গা থেকে সরে গেছে। কিন্তু প্রথম আলো করছে। তারা তাদের বানান চালু করেছে। কিন্তু যে শিশু বা শিক্ষার্থী বাংলা একাডেমির বানান দেখছে, আবার প্রথম আলোর বানান দেখছে— তারা তো বিভ্রান্ত হবে। এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ না দেওয়া। আর বাংলা বানান ব্যবহারের সময় সবাইকে যত্নশীল ও সতর্ক হতে হবে।’

এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘ইংরেজি বানান কেউ ভুল করতে চায় না। কিন্তু বাংলা লেখার বিষয়ে অনেকে সর্তক নন। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এনসিটিবি বাংলা একাডেমির বানান রীতি অনুসরণ করে। আর কেউ বানান নিজের মতো লিখবে তার সুযোগ নেই, প্রথম আলোর সেই এখতিয়ার নেই। রাষ্ট্র নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের বানান রীতি সবাই মেনে চলে। তা না করলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। যখন আরবির কোনও শব্দ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়, তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যেতে বলি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন যা সুপারিশ করবে, আমরা সবাই তাই ব্যবহার করবো।’