ব্রিটেনে ৫৫ শতাংশ বাংলাদেশি নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার!

ডক্টর নুজহাত জাহানঅফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইংল্যান্ড-ওয়েলসে প্রতি সপ্তাহে দুজন নারী তার বর্তমান অথবা সাবেক পার্টনারের হাতে নিহত হচ্ছেন। প্রতি চার জনের মধ্যে একজন নারী তার পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন।
তবে ব্রিটেনের চ্যারিটি সংস্থা ‘ফেইথ রিজিন ফাউন্ডেশন‘ (এফআরএএফ)-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলাদেশি নারীদের নির্যাতনের এক ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৪.৮ শতাংশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী কোনও না কোনওভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ নারী মৌখিক নির্যাতন বা বুলিংয়ের শিকার, ৭৮ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার আর ৫৫ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এ নারীদের ৮১ শতাংশ নির্যাতনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট করেন না। নির্যাতনের এই মাত্রা ও রিপোর্ট না করার প্রবণতা এশিয়ান কমিউনিটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
ফেইথ রিজিন ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ডক্টর নুজহাত জাহান তার চ্যারিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিগত দুই বছর আগে লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল, ব্রেন্ট কাউন্সিল, বার্মিংহ্যাম ও কভেন্ট্রি এলাকার ২৭০ জন নারীর ওপর জরিপ চালিয়ে নির্যাতনের এই ভয়াবহ চিত্র খুঁজে পান। যেহেতু টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় বাংলাদেশি কমিউনিটির আধিপত্য তাই এই জরিপটি বাংলাদেশি কমিউনিটির পারিবারিক নির্যাতনের একটা বাস্তব চিত্র বলেই মনে করেন ডক্টর নুজহাত।
গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ এশিয়ান কমিউনিটির মেয়েরা ভাষাগত জটিলতা, ইমিগ্রেশন সমস্যা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তার ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, সেই বিষয়গুলো প্রকাশ করতে চান না, বিষয়টিকে তারা চার দেয়ালের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান।

কাকলীর স্বামী তাকে কোনও খরচের টাকা দিতেন না। সন্তানের জন্য সরকার থেকে প্রাপ্ত অর্থও তার স্বামী আত্মসাৎ করতেন। দীর্ঘদিন নির্যাতন সহ্য করে কাকলী তার পরিবারের কাছে সহায়তা চাইলে কাকলীর বাবা-মাও তাকে ভুল বুঝে বিশ্বাস করতে চাইতেন না।

নির্যাতিতদের মধ্যে যারা ব্রিটিশ নাগরিক নন, তাদের ধারণা তারা ব্রিটেনের নাগরিক না হওয়ার কারণে হয়তো আইনি সাহায্য পাবেন না, অথবা কোথায় সহায়তা পাওয়া যাবে, এ বিষয়ে তারা পরিষ্কার ধারণা রাখেন না। ড. নুজহাত জাহান বলছেন, ব্রিটেনের নাগরিক নন, এমন নারীরা পরিবারের অন্য সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকলে সরকারের কাছ থেকে আইনগত সহায়তা পেতে পারেন। কিন্তু গবেষণায় অংশ নেওয়া ৬০ শতাংশ নারীই সরকারের কাছ থেকে এ ধরনের সুবিধা নিচ্ছেন না। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা সামাজিক সমস্যাকে দায়ী করছেন।
চক্ষুলজ্জার কারণে মেয়েরা নির্যাতনের কথা বলতে চান না। সংসার ভেঙে যাবে, এই ভয়ে অনেক সময় নির্যাতিত নারীর পরিবারের সদস্যরাও তাকে আইনি পদক্ষেপের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন।

১৯ বছর বয়সে বাবা-মায়ের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে সিলেটের দারীয়াপাড়ার মেয়ে কাকলি লন্ডন যান ২০০১ সালে। শুরু থেকেই তার স্বামী তাকে নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। স্বামীর পরিবারের অন্য সদস্যরা বলতে থাকেন, কাকলী দেখতে সুন্দর একসময় কাকলীর সন্তানকেও তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন তার স্বামী ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা।
কাকলী দেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও লন্ডনে যাওয়ার পর তাকে আর পড়তে দেওয়া হয়নি। ইংরেজি শিখে স্বাবলম্বী হতেও তার স্বামী তাকে সহায়তা করেননি। কাকলীর স্বামী তাকে কোনও খরচের টাকা দিতেন না। সন্তানের জন্য সরকার থেকে প্রাপ্ত অর্থও তার স্বামী আত্মসাৎ করতেন। দীর্ঘদিন নির্যাতন সহ্য করে কাকলী তার পরিবারের কাছে সহায়তা চাইলে কাকলীর বাবা-মাও তাকে ভুল বুঝে বিশ্বাস করতে চাইতেন না।

এক সময় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্থানীয় নার্সের সহায়তায় সোশ্যাল সার্ভিসের মাধ্যমে কাকলী আইনি পরামর্শ নিয়ে নিজে সাবলম্বী হবার অনুপ্রেরণা পান। নির্যাতনের জীবন থেকে বের হয়ে এসে ২০০৪ সাল থেকে কাকলীর সংগ্রাম শুরু হয়। ইংরেজি শিখে নিজেকে তৈরি করেন তিনি। কাকলীর ১৩ বছরের মেয়েটি এখন প্রতিদিন স্কুলে যায়, শতকরা ১০০ ভাগ স্কুলে উপস্থিতির জন্য তার সন্তানকে তিনটি দেশ ভ্রমণে নিয়ে গেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

৫৪.৮ শতাংশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী কোনও না কোনওভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ নারী মৌখিক নির্যাতন বা বুলিংয়ের শিকার, ৭৮ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার আর ৫৫ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।

সালেহা তার স্বামী কাসিমকে বিয়ে করে লন্ডনে এসেছেন। ইংরেজি জ্ঞান স্বল্পতার কারণে তার স্বামী তাকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি করে দেন। কিছুদিন পর সালেহা গর্ভবতী হলে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে দুই সন্তান কিছুটা বড় হলে সালেহা জানতে পারেন, তার স্বামী অন্য একটি মেয়ের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন। সালেহাকে না জানিয়ে তার স্বামী কাসিম সেই মেয়েকে নিয়ে হলিডেতে বেড়াতে গিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে স্বামীর কাছে কৈফিয়ত চাইলে শুরু হয় নির্যাতন, সালেহা যখন সন্তানদের সামনে তার স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে থাকেন, তখন তিনি বিষয়টি নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেন। বর্তমানে সালেহা মুক্ত ও স্বাধীন জীবন যাপন করছেন বলে জানিয়েছেন।

কাকলী কিংবা সালেহার মতো অসংখ্য নারী রয়েছেন যারা ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে থেকেও প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছেন স্বামী কিংবা পরিবারের অপর সদস্যদের দ্বারা। আর এধরণের নির্যাতন শুধু নির্যাতিত নারীটিকেই নয় তাদের সন্তানদের জীবনকেও প্রভাবিত করছে। নির্যাতনের শিকার ৫৭ শতাংশ নারীই নির্যাতিত জীবন থেকে বের হয়ে আসে না সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে, ৪২ শতাংশ নারী নির্যাতনের বিষয়ে চুপ থাকেন ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে।

নারীর উপর এমন নির্যাতন বন্ধে সমাজের যারা নেতৃস্থানীয় পুরুষ ও ধর্মীয় নেতা রয়েছেন তাদের এগিয়ে আসার কথা বলছেন ডক্টর নুজহাত, তবে তিনি এও জানিয়েছেন, শুধু নারীরাই নয়, পুরুষরাও নির্যাতিত হচ্ছেন, বিশেষ করে যে সকল পুরুষ বিয়ে করে ব্রিটেনে এসেছেন। তবে নারীর তুলনায় সেই সংখ্যা হয়তো কম। পারিবারিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে নারীরা সহায়তা চাইলেও নির্যাতনের শিকার পুরুষদের নির্যাতনের কথা স্বীকার করতে বা অভিযোগ উত্থাপন করতে দেখা যায়না।

পুনশ্চ: ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে নির্যাতনের শিকার নারীদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

এপিএইচ/