রাজশাহীর গোদাগাড়ির রইসুল ঢাকায় রিকশা চালান। ২০১৮ সালে তার চরের কিছু জমি নদীতে বিলিন হয়ে যায়। এরপর কাজ না পেয়ে তিনি প্রথমে রাজশাহী শহরে ও পরে ঢাকায় আসেন কাজের খোঁজে। শুরুতে পরিবার নিয়ে না এলেও কোভিডের পরের বছর তার ঘরটি ভেঙে গেলে স্ত্রী-সন্তানদেরও ঢাকায় নিয়ে আসেন। এখন ফেরার মতো আর কিছু অবশিষ্ট নেই এলাকায়। রইসুল উদ্বাস্তু। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় যে বস্তিতে থাকি, সেখানে দেশের নানা এলাকা থেকে লোক এসেছে সর্বস্ব হারিয়ে।’
নদীভাঙা ও ঝড়ের কবলে সব হারানো মানুষ সাময়িক কিছু সহায়তা পেলেও তাদের পুনর্বাসনের জন্য এগিয়ে আসে না কেউ। এরা শিকড়হীন হয়ে শেষ উপায় হিসেবে রাজধানীতে আসেন।
ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) তথ্যমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় সাত লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্প্রতি ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। সম্প্রতি ‘ইকোনমিকস ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ এর প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি সূচক ২০২২’ অনুযায়ী— বিশ্বের ১৭৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৬তম। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ঢাকায় বসবাসযোগ্যতা কোন পর্যায়ে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ জলবায়ু শরণার্থীদের শহরমুখী হওয়া ফেরাতে না পারলে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের বসবাসযোগ্যতার সূচক আরও নিচে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে সবাই রাজধানীতে আশ্রয় নিতে ছুটে আসছেন, সেহেতু এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামীতে ঢাকা অচল হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে এখনই পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্থানীয়ভাবে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু শরণার্থী সংকট সমাধানকল্পে এলাকাভিত্তিক চিন্তা করতে হবে। লোকজ প্রথা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই।’
দরকার সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ
বিভিন্ন গবেষণার সূত্র ধরে জলবায়ু বিশ্লেষকরা বলছেন, নদীভাঙনে প্রতি বছর উত্তর জনপদে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা অঞ্চলে অন্ততপক্ষে ১০ হাজার পরিবার বসতভিটা হারাচ্ছে। নদীভাঙনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরিত হওয়ায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। কুড়িগ্রামের চর এলাকায় প্রতি বছর বাল্যবিবাহ বেড়ে চলেছে। নদীভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে কারোর আবাদি জমি ডুবছে, কোথাও নতুন করে জাগছে। ফলে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। এই মানুষেরা কেন্দ্রের দিকে ছুটছে। ঢাকায় না এসেও জীবন-যাপন করতে যেন পারে, সেটার জন্য কী করণীয় জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। রুটি রুজি যেন এলাকায় নিশ্চিত হয়। তাহলেই আর সে শহরমুখী হবে না। কেবল নদীভাঙা গরিব লোক ঢাকায় আসছে, তা নয়। বাস্তবতা হলো, সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড়লোকটিও ঢাকাতেই আসতে চায়। ফলে সুবিধাদির বিকেন্দ্রিকরণ দরকার সবার আগে।’
জলবায়ু সহনশীল শহর তৈরিতে দ্য গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাক বাংলাদেশের মোংলায় একটি পাইলট প্রোগ্রাম চালু করেছে। এ অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা বরাবরই ছিল। তবে বর্তমানে মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শরণার্থী হওয়া মানুষদের জন্য ‘পিপলস ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন প্ল্যান’ গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্ল্যানটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে আলোচনার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে।
ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির প্রধান আবু সাদাত মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘আমার কাজের অভিজ্ঞতা হলো— মানুষের পেটে ভাত থাকলে, সে তার নিজ মাটি ছেড়ে যেতে চায় না। উদ্বাস্তু মানুষের পুনর্বাসনের জন্য স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়াটা খুব জরুরি। মোংলায় রেল যোগাযোগটা শুরু হলে আশেপাশের জেলার মানুষ সকালে কাজে এসে রাতে ফেরত যেতে পারবে। তখন তারা আর নিজ এলাকা ছেড়ে শহরমুখী হবে না। আমি আশাবাদী।’
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন