জাহাঙ্গীর গেট থেকে বিজয় সরণীর দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে ‘রত্নদ্বীপ’ নামে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে দীর্ঘদিন আগে। সেখানে যে ঝিনুক দেখা যায়, তা আমাদের দেশীয় কোনো প্রজাতির ঝিনুক নয়। আরেকটু এগিয়ে গেলে পরীবাগের মোড়ে হাতের বামে নজরে পড়বে খুব সম্প্রতি একুশ নিয়ে স্থাপিত ভাস্কর্য ‘জননী ও গর্বিত বর্ণমালা’। এতে দেখা যায়, মায়ের কোলে শহীদ সন্তান। কিন্তু মায়ের মুখের অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় না কান্না নাকি ক্ষোভ জমে আছে। মনোযোগ না দিয়ে দেখলে হুট করে মনে হতে পারে শহীদমাতার মুখে এক চিলতে হাসি।
এ ধরনের ‘আজব’ ভাস্কর্যের বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘শুনেছি একুশের ভাস্কর্যে বানানও ভুল আছে।’
তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে ভাস্কর মৃণাল হকের সঙ্গে কথা বলে দেখব, মায়ের মুখের অভিব্যক্তি নিয়ে আরেকটু কাজ করা যায় কি না।’
এছাড়া রাজধানীতে রয়েছে দুর্জয় (রাজারবাগ, ঢাকা), চিরদুর্জয় (রাজারবাগ, ঢাকা), বলাকা (মতিঝিল, ঢাকা), প্রত্যাশা (বঙ্গবাজার, ঢাকা), অর্ঘ্য (সায়েন্স ল্যাব বা সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ঢাকা), সাম্যবাদ (কাকরাইল, ঢাকা), ইস্পাতের কান্না (ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর) পুরনো বিমানবন্দরে ২৬ ফুট ঈগলের ভাস্কর্য, ভিআইপি টার্মিনালের প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল আকৃতির ম্যুরালসহ আরও অনেক ভাস্কর্য। এগুলো রাজধানীর সৌন্দর্য বর্ধনের চেয়ে হানি ঘটাচ্ছে বলেও মনে করেন শিল্পবোদ্ধারা। তারা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্যহীন বা অনর্থক ভাস্কর্য দিয়ে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়া যায় না। ভাস্কর্য স্থাপন বিষয়ে একটি কমিটি থাকা জরুরি যারা যাচাই বাছাইয়ে সহায়তা করবেন।
তেজগাঁও রোডের সাতরাস্তার মোড়ে ছিল ময়ূরের ভাস্কর্য রয়েছে। তা ছিল লোহা-লক্করের তৈরি। ওই ভাস্কের্যে ময়ূরী নয় পেখম তোলা ময়ূরকেই প্রকটভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বর্ষারানী’। এ নিয়ে নাগরিকরা মুখ টিপে হেসেছেন। ফ্লাইওভারের কাজের জন্য বর্তমানে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভাস্কর বলেন, ‘এসব নিয়ে সমালোচনা করলে শিল্পগুন নিয়ে কথা হচ্ছে সেটা বিবেচনা না করা হয়। যিনি এসব তৈরি করেছেন তার বিরুদ্ধে কথা হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই ধরে নেওয়ার প্রবণতাকে আমি ভয় পাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির অংশ না এমন কিছু দিয়ে ভাস্কর্য তৈরির প্রবণতা কেন এলো তা খতিয়ে দেখা উচিত। শেরাটনের সামনের ঘোড়ার গাড়ি যেমন দেশীয় গাড়ির মতো না, রত্নদ্বীপের কোনও সৌন্দর্যও শিল্পীচোখে ধরা পড়ে না। তাহলে এসব কেন মোড়ে মোড়ে বসানো হলো তার তদন্ত হওয়া দরকার।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং শিল্প সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একমত। রাজধানীতে যেমন আগের করা কিছু ভালো ভাষ্কর্য আছে, তেমনই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অনেক কদাকার ভাস্কর্যও আছে। এগুলো প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত সরকারের। যে কোনও ভাস্কর্য করার আগে কোনও ব্যক্তি যদি বিনামূল্যেও করে দিতে চান, তাও শিল্পবোদ্ধা একটি কমিটির মধ্য দিয়ে কাজটি সম্পাদন হওয়া জরুরি। তা না হলে, এসব জিনিস তৈরি হতে থাকবে এবং একসময় দেখবো শিল্পগুনহীন সংস্কৃতিবিচ্ছিন্ন কিছু এলোমেলো ভাস্কর্যে চারপাশ ভরে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম মিনিং আছে। কিন্তু যখন আমাদের ভাষা, চেতনা, ঐতিহ্য, ইতিহাসের প্রশ্ন, তখন অবশ্যই সেই সম্পর্কিত ব্যক্তিদের গবেষণালব্ধ একটা ফলাফল ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মর সামনে হাজির করা উচিত। ভাস্কর্য মানেতো কেবল একজন ব্যক্তির করা কোনও জিনিস না, পরবর্তী প্রজন্ম এর মধ্য দিয়ে একটা ইতিহাস, একটা চেতনাকে লালন করবে। যারা এটা বোঝেন তারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন এটাই আমরা আশা করি। তা না হলে এমন অনেক জিনিস তৈরি হয়ে যাবে যেগুলোর সঙ্গে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মর কোনও যোগ থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সড়কের নাম বা আমাদের শহীদদের নিয়ে ছোট ছোট নানা স্তম্ভ আছে। কিন্তু সেগুলো এমন পজিশনে আপনি খুঁজেও পাবেন না। যেগুলো ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, সেগুলো কীভাবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।’
দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘যে কোনও কিছু স্থাপনে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেওয়া লাগে এবং এগুলোর ভাস্কর মৃণাল হকও অনুমতি নিয়েছেন। যদি কোনও ভাস্কর্যের বিষয়ে অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানানোর অনুরোধ করছি। বিষয়গুলো শিল্পীর সঙ্গে আলোচনা করে অবশ্যই ঠিক করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি জননী ও গর্বিত বর্ণমালা শিরোনামে যে ভাস্কর্যটা হয়েছে সেটা নিয়ে আগেও কিছু অভিযোগ আমার নজরে এসেছে। সেখানে নাকি বানানও ভুল আছে। আমরা এগুলো ঠিক করার উদ্যোগ নেব।’
ছবি : নাসিরুল ইসলাম
/এজে/