কয়টি সংরক্ষিত আসন পেতে পারেন স্বতন্ত্র এমপিরা?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরই সবচেয়ে বেশি আসন (৬২টি) পেয়েছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পরের অবস্থান জাতীয় পার্টির (১১টি)। সংসদের সংরক্ষিত ৫০ আসন ভাগ হবে সরাসরি ভোটে পাওয়া আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। এই হিসাবে ১১টি আসন পেতে পারেন স্বতন্ত্র এমপিরা।

এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র এমপিদের এককভাবে জোটবদ্ধ না হয়ে খণ্ড খণ্ডভাবে হলেও জোটবদ্ধ হতে হবে। এতে একটি করে আসনে জয়ী তিনটি রাজনৈতিক দলের সংরক্ষিত একটি আসন পাওয়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে, তারা তা থেকে বঞ্চিত হবে। খণ্ড খণ্ড জোট হলে স্বতন্ত্র এমপিরা চাইলে ১১টিরও বেশি আসনও দাবি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাদের সমঝোতা করতে হবে। সমঝোতা না হলে নির্বাচন কমিশনকে স্বতন্ত্র আসনের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সংরক্ষিত আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচনের পথে যেতে হবে।

জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

গত ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে, বিদায়ী সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ১১টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয়লাভ করেছে। এছাড়া স্বতন্ত্র এমপিরা জিতেছেন ৬২টি আসনে। এমপি প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনের নির্বাচন বাতিল হয়েছে। নতুন তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ওই আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ৩০০টি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আসনের বাইরে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। সংরক্ষিত মহিলা আসন নির্বাচন আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের মোট আসন সংখ্যার আনুপাতিক হার অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল ও জোটের অনুকূলে সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলো বণ্টন হবে।

সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলো কোন প্রক্রিয়ায় বণ্টন হবে– তা আইনে স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। সাধারণভাবে প্রতি ছয়টি আসনের বিপরীতে কোনও দল বা জোট একটি সংরক্ষিত আসন পেয়ে থাকে।

আসন বণ্টনের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে– ‘সংরক্ষিত মহিলা আসনের মোট সংখ্যাকে (বর্তমানে ৫০টি) সংসদের সাধারণ আসনের মোট সংখ্যা (৩০০টি) দ্বারা ভাগ করিবার পর ভাগফল হিসাবে প্রাপ্ত সংখ্যা (১.৬৬৭) দিয়ে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল বা জোটের অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মোট আসন সংখ্যাকে গুণ করে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে সেই সংখ্যাই হবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল বা জোটের অনুকূলে বণ্টনতব্য সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা।’ যেমন- আওয়ামী লীগের ২২৩টি আসনের বিপরীতে সংরক্ষিত আসন হবে– ৫০x৩০০=০.১৬৬৭। এরপর ২২৩x০.১৬৬৭=৩৭.১৬৬৭। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ৩৭টি আসন পাবে। আইন অনুযায়ী ভগ্নাংশ শূন্য দশমিক পাঁচ (০.৫) বা তার বেশি হলে ভগ্নাংশকে পূর্ণ এক সংখ্যা গণনা করতে হবে এবং শূন্য দশমিক পাঁচ (০.৫) অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর হলে ওই ভগ্নাংশকে শূন্য সংখ্যা গণনা করতে হবে।

আইনে আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের পর বণ্টন করা আসনসমূহের যোগফল ৫০ (সংরক্ষিত মোট আসন)-এর চেয়ে বেশি হলে অতিরিক্ত আসন বা আসনসমূহ নির্ধারিত পদ্ধতিতে কাটা হবে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত আসনের সংখ্যা একটি হলে, যেসব দল বা জোট আনুপাতিক হারের ভগ্নাংশকে পূর্ণ সংখ্যা গণনা করার কারণে কোনও আসন পেয়েছে, সেসব দল বা জোটের মধ্যে ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশের অধিকারীর অনুকূলে বরাদ্দ করা আসন থেকে ওই অতিরিক্ত আসনটি কাটতে হবে। তবে ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশের অধিকারী দল বা জোটের সংখ্যা একাধিক হলে কার আসন কাটা যাবে, তা লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। অতিরিক্ত আসন সংখ্যা একাধিক হলে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।

সংসদ_অধিবেশন_জাতীয়_খ

আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের পর বণ্টন করা আসনসমূহের যোগফল ৫০-এর কম হলে এবং অবশিষ্ট আসনের সংখ্যা একটি হলে তা যে রাজনৈতিক দল বা জোটের অনুকূলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সংরক্ষিত মহিলা আসন বণ্টন করা হয়েছে তাদের অনুকূলে বণ্টন হবে।

আইনে আসন বণ্টনে ভগ্নাংশকে পূর্ণ সংখ্যা গণনার বিষয়ে কোনও বিতর্ক দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।

আইনের এই বিধান অনুসারে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পাবে–১১x০.১৬৬৭= ১.৮৩৪টি, অর্থাৎ ২টি আসন। এককভাবে জোটবদ্ধ হলে স্বতন্ত্র এমপিদের অনুকূলে সংরক্ষিত আসন হবে ৬২x ০.১৬৬৭ =১০.৩৩৪টি, অর্থাৎ ১০টি আসন। আর ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি জোটবদ্ধ হয়ে এলে পাবে ৩x০.১৬৬৭=০.৫০টি। অর্থাৎ ১টি আসন।

তবে স্বতন্ত্র এমপিরা এককভাবে জোটবদ্ধ না হলে খণ্ড খণ্ডভাবে জোট করলে এই হিসাব বদলে যাবে। তারা ৫ জন বা ৬ জন করে খণ্ড খণ্ড জোট হলে ১১টি আসন পাবে। একই প্রক্রিয়ায় ১১ জন করে জোট করলে ৫টি জোটের অনুকূলে ১০টি সংরক্ষিত আসনে এমপি ও বাকি ৭ জনের অনুকূলে আরও একটি সংরক্ষিত আসন পাবেন। ইচ্ছা করলে স্বতন্ত্ররা ৪/৫/৬ জন করে জোট করে একটি করে আসন দাবি করলেও আইনে বাধা থাকবে না। এক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা নির্ধারিত ৫০টি ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টি হস্তক্ষেপ করতে হবে। কিংবা স্বতন্ত্র এমপিদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সংরক্ষিত আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচন করতে হবে।

উল্লেখ্য, স্বতন্ত্র এমপিরা খণ্ড খণ্ড করে জোটবদ্ধ হলে একক জোটের অংশের ১০টির জায়গায় ১১টি আসন পেলে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি মিলে যে একটি আসন পাওয়ার কথা সেটা তারা পাবে না। 

সংসদ_অধিবেশন_জাতীয়_ক

আইন অনুযায়ী, নির্বাচিতদের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের পরবর্তী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে দল বা জোটগুলো বা স্বতন্ত্র এমপিদের তাদের জোটের অবস্থান নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। এদিকে গেজেট হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যদের রাজনৈতিক দল বা জোটওয়ারী সদস্যদের পৃথক তালিকা প্রস্তুত করবে বলে আইনে উল্লেখ রয়েছে। সে অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচনের জন্য আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যে দল বা জোটগুলোকে ইসিতে তাদের অবস্থান জানাতে হবে। ইসি আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সদস্যদের তালিকা (ভোটার তালিকা) প্রস্তুত করবে।

তালিকা প্রস্তুতের পরের কার্যদিবসে অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি সেই তালিকা নির্বাচন কমিশনে প্রকাশ্য কোনও স্থানে টানিয়ে দিতে হবে। একইসঙ্গে সংসদ সচিবালয়কে সেই তালিকার প্রত্যায়িত কপি টানিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠাবে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দল ও জোটগত অবস্থান জানানোর জন্য নির্বাচনে বিজয়ী সব রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন থেকে আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ইসিকে তাদের অবস্থান জানাতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী (হবিগঞ্জ-১) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে এরকম চিঠি দিয়েছে শুনেছি। কিন্তু আমার হাতে এখনও আসেনি। চিঠি হাতে পেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবো। সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে কী হবে এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

জাতীয় সংসদ (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে স্বতন্ত্র এমপিরা সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানান কেয়া চৌধুরী। আগামী রবিবার (২৮ জানুয়ারি) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।

পিরোজপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা কোনও দলে বা জোটে আছি কিনা সেটা ৩১ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। আমরা চাইলে ছয় জন করে একটি আসন চাইতে পারি। আবার সম্মিলিতভাবেও চাইতে পারি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচনি এলাকায় আছি। ঢাকা এসে সিদ্ধান্ত নেবো।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে অবস্থান জানতে স্বতন্ত্র এমপিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, স্বতন্ত্ররা সবাই একসঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তাদের অবস্থান জানাতে পারে। আবার চাইলে একাধিক জোট করেও সেটা করতে পারে। এটা নিয়ে আইনে কোনও বাধা নেই।