মানবিক বিপর্যয়: দুই মাসে অর্ধশত শিশু হত্যা

শিশু হত্যাসামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়ের কারণেই দেশে শিশু হত্যা বাড়ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। শিশু হত্যাকাণ্ডের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও দায়ী করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। বিগত দুই মাসে অর্ধশতাধিক শিশু হত্যার শিকার হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেওয়া পরিসংখ্যানে জানা গেছে। দেশে শিশু হত্যাকাণ্ডের  ঘটনা বেড়ে যাওয়াকে মানবিক বিপর্যয় বলেও মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের বিভিন্নস্থানে অর্ধশত শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিষ্পাপ শিশুদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। শিশুহত্যার মতো ঘৃণিত অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় শিশু হত্যার ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করে সংগঠনটি। এছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তির কু-প্রভাব, পর্নোগ্রাফির প্রসার, অনৈতিক জীবনযাপন, পাচার, বিরোধ-শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমাগত শিশু হত্যাকাণ্ডের কারণ বলে জানায় সংগঠনটি।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুদের ওপর অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সামাজিক অবক্ষয়, বিভিন্ন নৃশংস ঘটনার বিচার না হওয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণেও শিশুদের ওপর নৃশংসতা বেড়েছে বলে ধারণা তাদের।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালে যদিও কিছু কিছু অপরাধীর শাস্তি হয়েছে, তবু এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত আছে। মুক্তিপণ, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধের জের ধরে শিশুরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া উদ্বেগ ও দুঃখজনক।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বিগত বছর ২০১৫ সালে দেশে ১৩৩ শিশুকে হত্যা করা হয়। গেলো বছরটিও শিশুহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো ছিল দেশব্যাপী আলোচিত। শিশু নির্যাতনের মাত্রা ও ধরনে নিষ্ঠুরতা ছিল ভয়াবহ। সিলেটে পৈশাচিক নির্যাতনে শিশু রাজন হত্যার ভিডিওচিত্র ধারণ করে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই বছরের ৩ আগস্ট খুলনায় শিশু রাকিবকে হত্যার ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। এ বছরও এ ধারা অব্যাহত আছে বলে মনে করে সংগঠনটি।

গত ২৯ জানুয়ারি মাঠে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার মুগারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অবদুল্লাহ (১১)। পরে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি আবদুল্লাহর মায়ের মামা মোতাহার হোসেনের বাড়িতে তল্লাশী চালিয়ে একটি ড্রামের ভেতর থেকে আবদুল্লাহর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার প্রধান আসামি মোতাহার হোসেন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার আউটপাড়া এলাকা থেকে সোলায়মান (৪) নামে এক শিশুকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে দেড় লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। দুদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুরের জঙ্গল থেকে শিশু সোলায়মানের লাশ উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় স্থানীয় একটি সেলুনের কর্মচারী নির্মলকে আটক করে র‌্যাব।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের শিশু জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তাজেল মিয়া (১০), মনির মিয়া (৭) ইসমাইল হোসেন (১০) নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় ১৩ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ জাকারিয়া আহমেদের বাবা ওয়াহিদ মিয়া বাহুবল মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে নিখোঁজ মনির মিয়ার বাবা আবদাল মিয়া বাদী হয়ে বাহুবল মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ শিশুদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে পতিত জমির নিচ থেকে এই চার শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। গ্রামের পঞ্চায়েতের নেতৃত্ব নিয়ে আবদুল আলী বাগাল ও আবদুল খালিক মাস্টারের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত বাচ্চু মিয়া (৩২) র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার মাকুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এক সালিশি বৈঠকে চোর সন্দেহে ৫ম শ্রেণির ছাত্র রুমন, ৮ম শ্রেণির ছাত্র মেহেদী এবং ৩য় শ্রেণির ছাত্র ফিরোজ এর হাত রশি দিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলে তাদের লাঠিপেটা করা হয়। এই সালিশ কমিটির প্রধান মাকুপাড়া বাজার কমিটির সভাপতি ইমাজ উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সামাজিক অবক্ষয় ছাড়াও মানসিক কারণেও শিশুরা স্বজনদের হাতে হত্যার শিকার হচ্ছে। সর্বশেষ রাজধানীর বনশ্রীতে দুই শিশু হত্যার বিষয়টি মানসিক বিপর্যস্ততার কারণেই হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তবে এরসঙ্গে অন্য কারণও যোগ হতে পারে।

পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশে শিশু হত্যার বিষয়টি মানবিক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও এমনটি ছিল না। যেখানে সন্তানের জীবন রক্ষায় এবং নিরাপত্তায় মা-বাবারা জীবন পর্যন্ত দিতে পিছপা হন না। সেখানে সেই মা-বাবার হাতেই শিশু সন্তানরা খুন হচ্ছে। এক কথায় এটি ‘মানবিক বিপর্যয়’।    

/জেইউ/এএইচ/