দফায় দফায় সংঘর্ষে আরও একটি উত্তাল দিন

সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখন রক্তক্ষয়ী ঘটনাপ্রবাহে রূপ নিয়েছে। আন্দোলনকারী, ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছেই। মঙ্গলবার সারা দেশে ছয় জনের প্রাণহানির পরও থামেনি সংঘাত। বুধবারও বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে, আহত হয়েছে শত শত মানুষ।   

অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যার মধ্যে হল ছেড়ে যেতে বলা হয় (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বুধবার থেকে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে এবং হল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হল ছেড়ে গেছেন।  

সন্ধ্যার আগেই শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে দেখা যায় (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা

মঙ্গলবার নিহত ছয় জনের উদ্দেশে পৃথকভবে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বায়তুল মোকাররমে জোহরের নামাজের পর গায়েবানা জানাজা পড়েন বিএনপি ও যুগপৎ দলগুলোর নেতাকর্মীরা।  এসময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ, মির্জা আব্বাসসহ বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোটসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।

গায়েবানা জানাজায় বিএনপি ও সমমনা দলের নেতাকর্মীরা (ছবি: ফোকাস বাংলা)

জানাজার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দলীয় কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। 

আওয়ামী লীগ আয়োজিত গায়েবানা জানাজা (ছবি: আতিক হাসান শুভ)

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী সবুজ আলীর জানাজা আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। এদিন বিকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক। আরও উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মির্জা আজম, এসএম কামাল হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর, প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ।

কোটা আন্দোলনকারীদের উদ্যোগে গায়েবানা জানাজা (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বাস ভবনের সামনে গায়েবানা জানাজা পড়েন কোটা আন্দোলনকারীরা। জানাজা শেষে তারা সমবেত হয়ে টিএসসির দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন। তবে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ (ছবি: সুবর্ণ আসসাইফ)

হল ত্যাগের ঘোষণায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়ার নির্দেশের প্রতিবাদে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে হলের রুম থেকে নিচে নেমে এসে বিক্ষোভ করেন তারা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় কর্তৃপক্ষ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ (ছবি: এস এম তাওহীদ)

জাহাঙ্গীরনগরে রেজিস্ট্রার ভবনে হামলা    

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট সভায় হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়ার পর রেজিস্ট্রার ভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। কোটা আন্দোলনের সমন্বয়করা দাবি করছেন, আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ধরনের হামলা চালিয়েছে অনুপ্রবেশকারীরা। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান যখন সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত পড়ে শোনাচ্ছিলেন তখন শিক্ষার্থীরা দুয়োধ্বনি দেন। কিন্তু এরপর কিছু শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রার ভবনের দিকে জুতা ও জানালায় ইট নিক্ষেপ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত ঠেকাতে পুলিশের ব্যারিকেড (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

ঢাবিতে ব্যারিকেড, সাউন্ড গ্রেনেড

কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন ও হত্যার প্রতিবাদ জানাতে দুপুরের দিকে টিএসসিতে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেন ও তার তিন সহযোগী। পুলিশ  তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা সরতে না চাইলে চার রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। পরে আক্তার ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

অবস্থান নেওয়া ঠেকাতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কোটা আন্দোলনকারীরা। তবে পুলিশের বাধায় তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। বুধবার বিকালে তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিতে দেখা যায়। পরে সবাই ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হল ফাঁকা হয়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেও সরে যেতে বাধ্য হন আন্দোলনকারীরা (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

বুধবার রাত ৮টার দিকে ঢাবি ক্যাম্পাস ও হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার সদস্য মোতায়েন রয়েছে। ঢাবির বেশিরভাগ হল থেকে শিক্ষার্থীরা চলে গেছেন বলে জানান হলের সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিন ঢাবির মুহসীন, জসিমউদদীন, বঙ্গবন্ধু, জিয়া, বিজয় ৭১ ও এফ রহমান হল ঘুরে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সব শিক্ষার্থী হল ছেড়ে চলে গেছেন।

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ছবি: ফোকাস বাংলা)

ধৈর্য ধরার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

কোটা আন্দোলন নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তিনি এই ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

এছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও নাশকতাকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি আরও ঘোষণা করছি, হত্যাকাণ্ডসহ যেসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু বিচারের ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেসব বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বুধবারও বিক্ষোভ করেন ঢাবিতে (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা আন্দোলনকারীদের 

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত ও এক দফা দাবিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বুধবার (১৭ জুলাই) রাতে ফেসবুক পোস্টে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে পুলিশ (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

রাতে ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা, পুলিশের বাধা

কোটা আন্দোলনকারীরা বুধবার রাতে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা চালান। তবে পুলিশের বাধার পিছু হটতে বাধ্য হন তারা। এসময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। বুধবার (১৭ জুলাই) রাত সাড়ে ৯টার দিকে আন্দোলনকারীরা চানখারপুল এলাকা থেকে শহীদ মিনারের দিকে এগোনোর চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। তারা লাঠিচার্জ করে ও সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আন্দোলনকারীরা পিছু হটে আবার চানখারপুলের দিকে ফিরে যায়।

যাত্রাবাড়ীতে টোলপ্লাজায় অগ্নিসংযোগ (ছবি: সংগৃহীত)

দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্র যাত্রাবাড়ী-শনিরআখড়া

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা ও শনিরআখড়া এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ছুড়েছে পুলিশ। পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়েছে আন্দোলনকারীরা। এতে পুলিশের দুই জন সদস্য ও ৮ জন শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। 

কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অশান্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

এক পর্যায়ে শনিরআখড়ার কাজলায় হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা। বুধবার বিকালে থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে।

সংঘর্ষের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানা থেকে কুতুবখালি পর্যন্ত মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটি মোটরসাইকেল ও সিএনজি পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকরীরা। এর আগে যাত্রাবাড়ী থানায় হামলার ঘটনা ঘটে।

বুধবার প্রায় দিনভরই উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

সাংবাদিক ও পুলিশসহ ৫৫ জন ঢামেকে, গুলিবিদ্ধ ৬ 

কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও পথচারীসহ ৫৫ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫ জনকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।  ঢামেক পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. বাচ্চু মিয়া জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বুধবার সকাল থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আহতরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যান।