সারা দেশে গত এক সপ্তাহ ধরে চলা বন্যার দ্বিতীয় দিন থেকেই সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ সংগ্রহ তৎপরতা শুরু হয়। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সংগ্রহ করেছে। প্রথম সারির প্রায় প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একদিনের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শুকনো খাবার, পানি, ওষুধপত্র বিতরণ অব্যাহত থাকলেও প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় অনেকে ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করার বিকল্প নেই, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণে সদিচ্ছার অভাব নেই, কিন্তু প্রশাসনকে কাজে লাগাতে হবে।
এ কয়দিনে ১১টি জেলার ৭৪টি উপজেলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে বেশিরভাগ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এখনও পানিবন্দি হয়ে আটকা আছেন। বিভিন্ন প্রতিনিধির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা সড়ক-সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ত্রাণ সহায়তা দিলেও বেশি পানির কারণে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছানো যাচ্ছে না ত্রাণ সহায়তা।
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘দেশে বর্তমানে বন্যাপ্লাবিত জেলার সংখ্যা ১১টি। ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার পানিবন্দি। বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ২৭ জনের। আর ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন।’ তিনি জানান, বন্যা আক্রান্ত জেলার মধ্যে রয়েছে—ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এসব জেলার ৭৪টি উপজেলা বন্যাপ্লাবিত। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৫৪১টি।
সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিক্যাল টিম ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
খাদ্য সংকট আছে উল্লেখ করে বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুর রহমান বলেন, আমার এলাকায় ১৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। যে ত্রাণ আসছে, আমি শুরু থেকে চেষ্টা করছি সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করতে, যাতে সব পরিবার ত্রাণ পায়। যারা এলাকায় এসে যোগাযোগ করেন, তাদের আমরা একেকটি ইউনিয়নে যুক্ত করে দিই। কেউ কেউ নিজেরা এসে ত্রাণ দিয়ে চলে যান। আজকে আমার কাছে মাত্র দুটো টিম এসেছে। তাদের দুটি জায়গায় যুক্ত করে দিয়েছি। বাকিরা আজ কিছু পায়নি। সরকারিভাবে কী দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, চালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিবারপ্রতি ৫ কেজি পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এমন কোনও জায়গা নেই যে পানি ওঠেনি। ফলে তাদের রান্না করে খাওয়ারও বাস্তবতা নেই। এই পরিস্থিতিতে আমার এলাকায় খাদ্য সংকট রয়েছে।
কুমিল্লার লাকসামে বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সরকারি হিসাবে উপজেলার ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণের সংকট রয়েছে। নোয়াখালীর সংবাদদাতার তথ্য বলছে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ইতোমধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো থেকে যে পরিমাণ ত্রাণই যাক না কেন, নৌকার সংকটে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রশাসন তার যথাসাধ্য কাজ করছে না বলে মনে করেন উন্নয়ন ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, তাদের (প্রশাসন) পলিটিক্যাল চেন অব কমান্ড নেই। ১৫ বছর ধরে তারা যে সিস্টেমে অভ্যস্ত ছিল, সেটা এখন নেই। অনেকেই নতুন পোস্টিংয়ের ভয়ে ভীত। ইউনিয়ন পরিষদ এখন একমাত্র ভরসা। এদের ভেঙে না দিয়ে এই মুহূর্তে কাজে লাগাতে হবে। ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে গার্লস গাইড, স্কাউট, বিএনসিসি ইত্যাদি থেকে তরুণদের সংযুক্ত করতে হবে। জেলা রেডক্রস কাজ করছে না, কারণ তাদের সবাই ছিল পার্টির লোক। এগুলো ঠিক করতে হবে।