‘আমার ভাই লেবানন থেকে ফোন দিয়ে বলতেছে, মরে গেলে সবাইকে বলিস দোয়া করতে, বলিস আমাকে মাফ করে দিতে’––লেবানন প্রবাসী আমিনুল ইসলামের ভাই শাহিনুল ইসলাম শাহিন বাংলা ট্রিবিউনকে এই কথাগুলো বলেন। আমিনুলের মতো লেবানন প্রবাসী অন্য বাংলাদেশিরাও এখন প্রাণভয়ে আর আতঙ্কে দিন পার করছেন। প্রতিনিয়ত দেশে অবস্থানকারী স্বজনদের কাছে নিজেদের ভয়ের কথা জানাচ্ছেন তারা। লেবাননের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাই যেভাবেই হোক দেশে ফেরানোর ব্যবস্থার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
লেবাননে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। গত মঙ্গলবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ৪৯২ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত ২০ বছরের মধ্যে একদিনে দেশটিতে এত বেশি প্রাণহানি আর হয়নি। এদিন আহত হন দেড় হাজারের বেশি। হতাহতের মধ্যে বেসামরিক নাগরিক বা যোদ্ধাদের সংখ্যা কতো সে সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিরাস আবিয়াদ বলেছেন, হামলার কারণে হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ বু হাবিব বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান জোরদার করার পর থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখে পৌঁছেছে। হামলার আগে লেবাননে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার। কিন্তু কয়েক দিন ধরে লেবাননের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি হামলা বাড়তে থাকায় লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
লেবাননের ক্রমবর্ধমান সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মধ্যে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের হিসাবে, এই মুহূর্তে প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক আছেন দেশটিতে।
সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়েছে দক্ষিণ লেবানন। হামলায় বাদ পড়েনি রাজধানী বৈরুত। দেশটির বিভিন্ন এলাকা থেকে বাংলাদেশিরা তাদের স্বজনদের বলছেন, লেবাননের বর্তমান অবস্থায় যে যার জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় আছেন। প্রাণ বাঁচানোর জন্য অনেকেই বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। প্রবাসীরা বিভিন্ন মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে খাবার আর থাকার জায়গার ব্যবস্থা করছেন।
লেবাননের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া বেলাল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের একটি এলাকায় পাঁচ-ছয় হাজারের মতো বাংলাদেশি ছিল। হঠাৎ দুদিন আগে ইসরায়েলের জোরালো হামলার কারণে ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হই। পরে আমরা এক রাত আরেকটি এলাকায় অবস্থান করি। কিন্তু সেখানেও দেখি নিরাপদ না। সাত-আট বছর ধরে লেবাননে থাকি, কিন্তু এরকম পরিস্থিতি কখনও আমাদের সামনে আসেনি। কী করবো এমন অবস্থায় তা-ও ধারণার মধ্যে ছিল না। বাড়িতে যোগাযোগ করলাম, জানালাম অবস্থা। বাড়ি থেকে বলছে ফেরত চলে আসতে। এখন কীভাবে দেশে যাবো তাও জানি না।
বছরখানেক ধরে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি রাজধানীর বৈরুতও মুহুর্মুহু আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং বিশ্লেষকরা সমগ্র লেবানন, বিশেষত দক্ষিণ ও পূর্ব লেবানন এবং বৈরুত আরও বড় ধরনের হামলার শিকার হতে পারে বলে প্রতিনিয়ত আশঙ্কা প্রকাশ করে যাচ্ছেন।
এমন অবস্থায় লেবাননের পরিস্থিতি নিয়ে বৈরুতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) এক জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। সব প্রবাসী বাংলাদেশিকে নিরাপদ অবস্থানে থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য বিশেষভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে দূতাবাসের পক্ষ থেকে। যেসব এলাকায় ইসরায়েলি আক্রমণের কারণে অবস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না, সেসব স্থান থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীদের দূতাবাস বর্ণিত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
লেবাননে অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দেশে ফেরত যেতে আগ্রহী প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য দূতাবাসের ফ্রন্ট ডেস্ক––৭১২১৭১৩৯, হটলাইন নম্বর-৭০৬৩৫২৭৮, হেল্পলাইন নম্বর-৮১৭৪৪২০৭ এবং beirut.mission@mofa.gov.bd- ইমেইল ঠিকানায় যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
লেবাননে অবস্থানরত প্রবাসী শেখ মামুন এক ভিডিও বার্তায় জানান, যুদ্ধকবলিত এলাকায় যারা আছেন, পরিস্থিতি শোচনীয় না হলে দ্রুত তারা বৈরুতের দিকে চলে আসুন। তিনি এই সময় মনোবল না হারানোর পরামর্শ দেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের। তিনি বলেন, প্রবাসে আমাদের অভিভাবক দূতাবাস। আসলে দূতাবাস এমন একটা জায়গায় অবস্থিত, পরিস্থিতি বিবেচনায় সেখানে অনেকেই অফিস করতে পারছেন না। এছাড়া বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন মনোবল হারালে চলবে না। আমরা আশাবাদী, অচিরেই এই সমস্যার সমাধান হবে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, লেবাননের পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। যদি কেউ নিজ উদ্যোগে দেশে ফিরে আসতে চান, সেক্ষেত্রে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।
উল্লেখ্য, চলমান পরিস্থিতিতে ভারতীয় নাগরিকদের লেবানন ত্যাগ করার বার্তা দিয়েছে দেশটির দূতাবাস। পাশাপাশি দূতাবাসের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও যোগাযোগ রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে নাগরিকদের লেবাননে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে ভারতীয় দূতাবাস।