জীবনী ক্ষমতা বেড়েছে: দীর্ঘদিন একই কীটনাশকে মরছে না মশা!

মশক নিধনআকৃতিতে বেশ ছোট হলেও পৃথিবীর ক্ষতিকর প্রাণীগুলোর একটি হলো ‘মশা’। এদেশে যতো ধরনের মশা রয়েছে তার মধ্যে ভয়ঙ্কর হলো কিউলেক্স, অ্যানোফিলিস ও এডিস। কিউলেক্স ও অ্যানোফিলিসের দংশনে ম্যালেরিয়া ও গোদরোগ এবং এডিসের দংশনে প্রাণঘাতী ডেঙ্গুরোগ হতে পারে। পরিবেশের ওপর কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নেই মশার।
বিরক্তিকর এই মশার উৎপাত থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন রীতিমতো কামান দাগাচ্ছে মশা মারতে। প্রতিদিন বিষাক্ত কীটনাশক ছিটাচ্ছে ড্রেন ও নর্দমায়। কিন্তু মশা মরছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ঢাকার মশার কীটনাশক প্রতিরোধ ও জীবনী ক্ষমতা বেড়েছে। তাই স্বল্পমাত্রার কীটনাশকে কাজ হচ্ছে না। মশার সহ্য ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তারা বলেন, একই কীটনাশক বছরের পর বছর ব্যবহার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও ওষুধের মান ও মাত্রা ঠিক রাখা হচ্ছে না। ফলে মশারা এই ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন গত ১০ মার্চ বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের এক সভায় বলেন, ‘মশক নিধনের স্প্রেম্যানরা ওষুধ ছিটানোর পর মশারা পড়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার উড়ে যায়। তাই আমি বলেছি, ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু ওষুধের মাত্রা বাড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তি রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এই শহর থেকে মশা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। আমরা সে চেষ্টা করছি।’ প্রসঙ্গত, মেয়র বর্তমানে বিদেশ সফরে রয়েছেন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে সকালে ও বিকালে দুই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয় মশক নিধনে। মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে সকালে স্প্রে মেশিন দিয়ে ছিটানো হয় ‘লার্ভিসাইড’ এবং বিকালে উড়ন্ত মশা মারতে কামান সদৃশ ফগার মেশিন দিয়ে ছিটানো হয় সাদা ধোয়ার মত ‘এডালটিসাইড’।

লার্ভিসাইড হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বর্তমানে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে তার নাম ‘টেমিফস’। প্রতি দুই মিলিলিটার টেমিফসের সঙ্গে দশ লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে মেশিন দিয়ে এই কীটনাশক ব্যবহারের বিধান রয়েছে।

এডালটিসাইড হল ‘প্রালেথ্রিন’, ‘পারমেথ্রিন’ ও ‘টেট্রামেথ্রিন’ নামক তিনটি রাসায়নিকের সংমিশ্রণ। উপাদানগুলোর মধ্যে প্রালেথ্রিন কিলিং এজেন্ট (হত্যা করতে) হিসেবে, পারমেথ্রিন নকডাউন এজেন্ট (অজ্ঞান করতে) হিসেবে এবং টেট্রামেথ্রিন উভয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এডালটিসাইড ব্যবহার করা হয় রেডি অবস্থায়। ব্যবহারের আগে এই রাসায়নিকের সঙ্গে কেরোসিন এবং এই কেরোসিনের কারণে যাতে উৎকট গন্ধ না ছড়ায় সে জন্য জেসমিন নামের সুগন্ধিজাতীয় আরেকটি রাসায়নিক মেশানো হয়। এক লিটার এডালটিসাইড তৈরি করতে লাগে প্রালেথ্রিন দশমিক ২ গ্রাম, পারমেথ্রিন দশমিক ২ গ্রাম এবং টেট্রামেথ্রিন দশমিক ২ গ্রাম।

ঠিকাদারের মাধ্যমে কীটনাশক কিনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর মান পরীক্ষা করতে একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটির প্রধান হলেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা এই কমিটির সদস্য সচিব। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংসের দু’জন প্রতিনিধি।

বুধবার বিকালে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংসের দফতরে গিয়ে এই কমিটির সদস্য এবং উইংসের উপপরিচালক মো. আতাউর রহমানকে পাওয়া যায়নি। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে অন্য এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,যথাযথভাবে আমরা কীটনাশকের মান পরীক্ষা করে থাকি। এরপর এই কীটনাশক কিভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা সিটি করপোরেশনই ভাল বলতে পারবে। অন্যদিকে আইইডিসিআর-এর এক কর্মকর্তা বলেন,কীটনাশক ব্যবহারের ডোজ ঠিক করে দেওয়া আছে।এই ডোজ অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহার হলে কাজ তো হওয়ার কথা।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, আইইডিসিআর থেকে লার্ভিসাইডের সঙ্গে পানি মেশাতে যে অনুপাত ঠিক করে দেওয়া হয়েছে সেটা যথাযথভাবে মানা হয় না। অনেক সময় নির্ধারিত মাত্রার বেশি পানি মেশানো হয়ে থাকে। এডালটিসাইডের মান পরীক্ষার পর এর সঙ্গে পোড়া মবিল কিংবা তেল মেশানো হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে প্রতি লিটার এডালটিসাইড কেনা হয় ৩৩৪ টাকায়। এক লিটার কীটনাশক চুরি করে এর পরিবর্তে সমপরিমাণ কেরোসিন বা পোড়া মবিল মেশালে প্রায় ৩০০ টাকা লাভ হয়। এ ছাড়া এডালটিসাইডের তিনটি উপাদানের মধ্যে কখনও কখনও একটি বাদ দেওয়া হয়। প্রালেথ্রিন বাদ দিলে তখন মশা আর মরে না, কেবল অজ্ঞান হয়ে কিছুক্ষণ পড়ে থাকে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াৎ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তিন জায়গায় কীটনাশকের মান পরীক্ষা করা হয়। এখানে ভেজালের কোনও আশঙ্কা নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. সাইদুর রহমান মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজধানীর মশক নিধনে আশির দশক পর্যন্ত ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাইফেনাইল ট্রাইক্লোরো ইথেন) ব্যবহার করা হতো। এক পর্যায়ে দেখা গেল ডিডিটিতে কিউলেক্স মশা মরে না। তখন কীটনাশক পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে মশার কীটনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা শুধু কীটনাশক ব্যবহার করে যাচ্ছি। এনিয়ে কোনও জরিপ করা হয়নি।

তিনি বলেন, স্প্রেম্যানরা যথাযথভাবে কীটনাশক ছিটাচ্ছে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে নগরীর এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে কীটনাশক ছিটানো সম্ভব হয় না। যেমন অনেক ড্রেন বন্ধ হয়ে আছে। সেখানে কীটনাশক স্প্রে করা যায় না। ফলে ওইসব ড্রেনের আশপাশে কীটনাশক স্প্রে করলেও বদ্ধ ড্রেন থেকে দলে দলে মশা বেরিয়ে আসে।

বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি প্রফেসর খান হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মশা মারার পদ্ধতি ও কীটনাশক নিয়ে গবেষণার দরকার। কেননা, এখন যে ডোজে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেটা মশার সহ্য হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়ে থাকে।

ওএফ /এমএসএম/টিএন/আপ-এজে/