স্বাধীন সাংবাদিকতায় আজও বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার লড়াই চলছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, শারীরিক ও মৌখিক হামলা এবং সামাজিক মাধ্যমে হুমকি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস-২০২৫ উপলক্ষে রবিবার (৪ মে) ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কার্যালয়ে ‘সাহসী নতুন বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের স্বাধীনতার রোডম্যাপ সংস্কার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন।
ইউনেস্কো ঢাকা অফিস, টিআইবি ও সুইডেন দূতাবাস যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান ছাড়াও অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে কামাল আহমেদ সাহসী নতুন বাংলাদেশ: গণমাধ্যম স্বাধীনতার জন্য সংস্কার রূপরেখা— শীর্ষক মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
কামাল আহমেদ বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সামান্য আপত্তি উঠেছে— সাংবাদিকদের জন্য একটি জাতীয় ন্যূনতম বেতন স্কেল নির্ধারণ, যা সমতুল্য সরকারি চাকরির বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। সমালোচকরা বলছেন, আর্থিক সংকটে থাকা খাতের জন্য এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং এটি মানা হলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ, নিবিড়ভাবে যাচাই করলে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ঘোষিত অষ্টম ওয়েজ বোর্ড যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হতো (নিয়মিত ইনক্রিমেন্টসহ), একজন রিপোর্টার বা সহ-সম্পাদকের বেতন এতদিনে ৯ম গ্রেডের সরকারি কর্মচারীর সমতুল্য হতো। যেসব সংবাদপত্র মালিক এই সংস্কারের বিরোধিতা করছেন, তারা মূলত সাংবাদিক-কর্মচারীদের ন্যায্য বেতন না দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের সুবিধা নিতেই বেশি উৎসুক। আমাদের পরামর্শ সভায় দেখা গেছে, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম উভয়েই আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা তাদের আপস করতে বাধ্য করছে। ন্যায্য পারিশ্রমিক ও নীতিগত সহায়তা সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকতায় সেলফ সেন্সরশিপও বেড়েছে। সম্প্রতি একজন উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার জেরে তিনজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় অনলাইন ও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত বা প্রতিকার চেয়ে অনেকেই একটি স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন ও সাংবাদিক সুরক্ষা অধ্যাদেশ দ্রুত প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছেন।’
সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, কিছু সমালোচক ভারতের উদাহরণ টানলেও, মুক্ত গণমাধ্যমের বৈশ্বিক সূচকে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। চলতি বছরের সূচকেও ভারত বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। সেখানে সংবাদমাধ্যমের ‘গদি মিডিয়া’ নামকরণ থেকেই গণমাধ্যমগুলোর অবস্থান স্পষ্ট। মূলধারার প্রায় সব গণমাধ্যমই হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নীতি-আদর্শের প্রসারে নিয়োজিত।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের নিহত হওয়ার পরিসংখ্যান উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, ‘এ বছরে প্রথম চার মাসে ১৫ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে নিহত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের সংখ্যা ২০০ জন। এই ট্র্যাজেডির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা নিজেদের মুক্ত সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক দাবি করেন, তারা নীরবতা পালন করছেন। শুধুমাত্র ফিলিস্তিনি পরিচয়ের কারণে তাদের এই নীরবতা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি কোনও পশ্চিমা সাংবাদিকের প্রাণ হারাতো, তাহলে কী পরিমাণ ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দেখা যেতো। এ ধরনের দ্বৈত নীতি চলছে।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো পশ্চিমা দেশগুলোর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির সহযোগিতায় ইসরাইল এমন হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এআইয়ের সামরিক ব্যবহার চলছে। এমনকি আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়েও অনেক সংবাদমাধ্যম বন্ধ হতে দেখা গেছে। নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি সাংবাদিকরা আরও চ্যালেঞ্জের মুখে। এই অবস্থায় এ দেশের সাংবাদিকদের আরও সাহসী হতে হবে। বৈশ্বিক বাস্তবতায় সাহসী হওয়া কঠিন হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে গণমাধ্যম সংস্কারের চ্যালেঞ্জ অনেক কঠিন।’
অনুষ্ঠানে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি ও টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। স্বাধীনতার পর দেখেছি কোনও সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে ফাংশন করতে পারেনি। অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ১৬ ধাপ এগোনোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, কথা বলার অবস্থা ছিল না। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমরা ১৬ ধাপ এগিয়েছি। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে ৩২ ধাপ পেছাবো না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে।
সাংবাদিকতা না থাকলে কে আমার জীবনের নিরাপত্তা দেবে, কে আমার সম্পদের নিরাপত্তা দেবে, কে সমাজকে নিরাপত্তা দেবে’— এসব প্রশ্ন রাখেন এ কে আজাদ।