২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার একে একে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনগুলোর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি করছে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। সরকার জুলাই মাসেই রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরে এই সনদ জাতির সামনে উপস্থাপন করবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জানিয়েছেন, জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ চলতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে করার প্রতিশ্রুতি ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। তারা আশা করছেন, চলতি মাসের শেষ দিকে হয়তো সনদ বাস্তবে চেহারা দেখতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে— আদৌ এই সনদ ভবিষ্যৎ জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে কতটা কার্যকর ও মুখ্য ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির অবস্থান মৌলিকভাবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
দলটির পক্ষ থেকে দুইবারের বেশি টানা একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় নীতির বাইরে রাখা, সংসদে সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীলতা সৃষ্টিসহ নানা বিষয়ে সরকার পক্ষের সঙ্গে এখনও দূরত্ব রয়েছে। আর এই দূরত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সরকারের ঘনিষ্ঠ দল এনসিপি, জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের দৃশ্যমান বক্তব্যে। এই দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে বেশ কিছু দ্বিমত জানিয়েছে।
‘জুলাই সনদ’ নিয়ে সরকারের আশা
প্রধান উপদেষ্টা গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে ভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘আগামী জুলাই মাসেই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে আমরা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারবো বলে আশা করছি। এই জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কয়টিতে একমত হয়েছে— তার তালিকা থাকবে এই সনদে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে তারা জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।’
অধ্যাপক ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পরই কয়েক দফায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, শ্রম খাত সংস্কার কমিশন, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনগুলোর মধ্য থেকে কয়েকজনকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
নোবেলজয়ী সরকারপ্রধান আরও বলেন, ‘জুলাই সনদ অনুযায়ী আশুকরণীয় সংস্কার কাজগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাকি অংশের বেশকিছু কাজও আমরা শুরু করে যেতে চাই। আশা করি, অবশিষ্ট অংশ পরবর্তীকালে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের কাছে দেশের নতুন ঐক্যবদ্ধ ভাবমূর্তি তুলে ধরা যাবে। বিশ্বব্যাপী সবার কাছে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে।’
অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে জানান, ঐকমত্য কমিশন গঠন করা আমাদের একটি দুঃসাহসিক উদ্যোগ ছিল। অন্য কোনও দেশে এমন কোনও নজির নেই। এর মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে রাজনৈতিক গভীরতার সন্ধান পেয়েছি। রাজনৈতিক ঐক্যে পৌঁছার জন্য ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সব দলের দলগত প্রস্তুতি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কমিশনের সঙ্গে ঐকান্তিক আলোচনা, জাতীয় লাইভ টেলিভিশনের সামনে সব দলের ঐকমত্যে পৌঁছার একান্ত প্রয়াস আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সব রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের সীমাহীন ধৈর্য এবং কমিশনের প্রতি তাদের সহযোগিতা এবং সৌজন্য প্রকাশের জন্য জাতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, আমাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করে জাতির জন্য একটা নতুন পথনির্দেশনা রেখে যেতে পারবো।’
‘এই কমিশনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সেটা বিকাশমানভাবে স্থায়ী রূপ নিতে পারি, তাহলে আমরা ভবিষ্যতের সব রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। সব প্রস্তুতি সমাপ্ত করে দেশের সব মানুষের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক-জেলে, গৃহিনী, দিনমজুর, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিল্পী- সবাই মিলে চেষ্টা করে একটি সুন্দর, নিখুঁত নির্বাচন আয়োজন করে নতুন বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি রচনা করবো।’
কতটা ঐকমত্যে হচ্ছে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ
ঐকমত্য কমিশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে উল্লেখ করেন, ন্যূনতম সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির যদি আন্তরিকতার অভাব থাকে তাহলে উভয়পক্ষের জন্য হিতে বিপরীত ফলাফল ডেকে আনতে পারে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে দলটিকে আন্তরিক অবস্থান ব্যক্ত করা উচিত, বলে মনে করেন এই সদস্য।
বিএনপির একজন উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল মনে করেন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো উভয়পক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে সনদ চুক্তি করলে রাজনীতির জন্য শুভ। অন্যথায় ভবিষ্যতে পরস্পরবিরোধী ‘তর্ক-বিতর্কের’ জমিন হিসেবে কাজ করবে এই সনদ।
‘উভয়পক্ষের আন্তরিকতা ও সুসম্পর্কের ভিত্তিতে জুলাই বা জাতীয় সনদ চুক্তি হলে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য রাজনৈতিক বার্তাবাহী হবে। আর উভয়পক্ষ বাধ্য হয়ে করলে আলোর মুখ দেখার কোনও সুযোগ নেই।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে— যেসব সংস্কার আশু করা যাবে তা সম্পন্ন করা। তবে যেসব সিদ্ধান্ত বা সংস্কারে জনগণের মতামত লাগবে, সে জন্য সেসব বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ইতোমধ্যে আমাদের দলের পক্ষে সরকারকে সব কিছু জানানো হয়েছে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ৩ জুন রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার শুরুতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবই চূড়ান্ত নয়৷ রাজনৈতিক দলগুলো যেসব মতামত দিয়েছে— তার ভিত্তিতে পরিবর্তিত প্রস্তাব নিয়েই রচিত হবে জাতীয় সনদ।’
‘সব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে না’ উল্লেখ করে কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, ‘আমরা কিছু জায়গায় একমত হবো। বাকিটা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জনগণ কতটা গ্রহণ করবে সেটা তাদের বিষয়।’
জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, আমরা যেন ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে সনদ দেওয়ার কথা আলোচনায় এসেছে। আমরা আশা করছি, জুলাইয়ের মধ্যে তারা জুলাই সনদ জনগণের সামনে হাজির করবেন।’
‘আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে যথাসম্ভব ঐক্য সৃষ্টি করতে চাই।’ উল্লেখ করে সাকি বলেন, ‘যেসব বিষয় ঐকমত্য হবে সেগুলো নিয়ে সনদ বা জাতীয় সনদ আকারে ঘোষণা করার পক্ষে। আলোচনার পরও যেগুলোতে দ্বিমত থাকবে সেগুলো জনগণের কাছে যাবে, নির্বাচনের মধ্যে যাবে। যে দলকে জনগণ বিজয়ী করবে তারাই সেগুলো বাস্তবায়ন করবে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ যা-ই বলেন, এখনও নাম ঠিক হয়নি। এ নিয়ে আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব চলছে। সব কিছু চূড়ান্ত হলে জানা যাবে।’
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খানের ভাষ্য, ‘সংস্কার এবং ঐকমত্য দেশের প্রয়োজনে বিএনপি সবার আগে পরিকল্পিতভাবে ৩১ দফায় ঘোষণা করেছে। সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশন যদি বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফাকে মূল্যায়ন করে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে, তাহলে জাতির জন্য কল্যাণকর হবে।’
‘জুলাই ঘোষণা’য় রাজনৈতিক দলগুলোর নীরব দ্বিমত
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতারা বলছেন, অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতাদের এনসিপি-অংশটির মূল আগ্রহ ‘জুলাই প্রক্লেমেশন বা জুলাই ঘোষণা’য়। তাদের আগ্রহ থাকলেও প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি কোনোভাবেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে চব্বিশের অভ্যুত্থানকে তুলনীয় হিসেবে দেখছে না।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দলীয় মতামত ছাত্রনেতাদের হাতে দেওয়া হলেও তারা প্রোক্লেমেশন বা ঘোষণার প্রতি আগ্রহ খানিকটা কম। এছাড়া জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল ও বাম ঘরানার দলগুলোও একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ২৪ এর যোগসূত্রতা বা তুলনীয় করার বিপক্ষে। যে কারণে তাদের তরফে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে আলোচনা বা নাড়াচাড়া অনেক কম।
ছাত্রদের একাংশের দল এনসিপি ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো এক্ষেত্রে আগ্রহের শীর্ষে
অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, ছাত্রদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে জুলাই ঘোষণার চাপ দেওয়া হলে তিনিও বিব্রত ও বিরক্ত হন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকেও তিনি এ বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন। যার খানিক রেশ দেখা গেছে সর্বশেষ ভাষণেও।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ঈদের আগের দিন (৬ জুলাই) তার নির্বাচনি রোডম্যাপের ভাষণে বলেছেন, ‘‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে— জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব ও অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা একটি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। তারা আমাকেও সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। আমি বলেছিলাম, দেশের সব রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সবাই মিলে এ ঘোষণাপত্র দেওয়া ভালো হবে।’’
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কী হচ্ছে এ নিয়ে সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু বলছে না। আমাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা।’
‘তারপরও যেহেতু আইন উপদেষ্টা ৩০ কার্য দিবসের একটি সময়সীমার কথা বলেছেন, আমরা সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় রয়েছি। এর মধ্যে জারি না হলে আমরা কঠোর অবস্থানে যাবো। প্রয়োজনে আন্দোলন করে দাবি আদায় করবো।’
প্রসঙ্গত, গত ১০ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের অগ্রগতি হচ্ছে। আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তা প্রকাশ করা সম্ভব হবে।
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার প্রত্যয়ে’ ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনা হয়। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছিলেন, ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র উত্থাপন করা হবে।
ঘোষণাপত্রে দুইটি মৌলিক বিষয় হিসেবে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ‘মুজিববাদী সংবিধান’ আখ্যায়িত করে এর ‘কবর রচনা করা ও নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করার কথা বলা হয়। পরদিন ৩০ ডিসেম্বর রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে।
সরকারের এ ঘোষণার পর ৩১ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলা হয়। নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম তখন জানান, শহীদ মিনারে ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলিউশন’ ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ তৈরির ঘোষণাকে তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ পালন করা হয়। তখন তারা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেন। সে অনুযায়ী ঘোষণাপত্রের পক্ষে ১১-১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তারা গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেন।
এরপর চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জুলাই অভ্যুত্থানের অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ওই বৈঠকে রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান উপদেষ্টা জানান, ছাত্ররা শহীদ মিনারে গিয়ে জুলাই ঘোষণায় অংশগ্রহণ করতে বললেও তিনি তাতে সায় দেননি। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে ঐক্যের মাধ্যমে। তাই এ বিষয়েও সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে চান। গত ৬ জুন (শুক্রবার) সন্ধ্যায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
এর আগে ২ জুন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন , ‘সরকার ঘোষিত ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে।’ এর আগে তিনি নির্বাচনের রোডম্যাপ চান না বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র আমরাও চাই। তবে এতে জুলাই-আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পাশাপাশি বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্টবিরোধী সংগ্রামকেও মূল্যায়ন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কারণ অভ্যুত্থান হুট করেই আসেনি। আমরা মনে করি, জনগণের ভোটাধিকার ও ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিক পরিণতি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। তাই যার যতটুকু অবদান তার স্বীকৃতি দিতে হবে।’ আশা করি, এর মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।’ বলেন রাশেদ খান।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির মনে করেন, ‘জুলাই ঘোষণার বিষয়টি সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হবে।’
‘এর মধ্যে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে আগে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বিগত সাড়ে ১৫ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গুম-খুনের বিষয়গুলো যেন স্থান পায়, সে বিষয়টিও দেখতে হবে।’ বলেও জানান নাছির।
জানতে চাইলে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ছাত্রদের পক্ষ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছিলে। আমরাও মতামত দিয়েছি। এখন সরকারের পক্ষ থেকে তা ঘোষণা করা হবে।’
সোমবার (৯ জুন) সরকারের জুলাই প্রোক্লেমেশন প্রস্তুতের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চেয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।