সময়ের বহমানতায় ততদিনে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অন্তরের মানুষ হয়ে ওঠা লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত প্রায় সকল লেখাই পড়া হয়ে গেছে। বই তো সব সঙ্গতকারণেই কিনে পড়তে পারতাম না। নানাজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে ও দিয়ে মনের সাধ মেটাতে হতো। পেতাম উপহারও। এদের মধ্যে একজনের নাম বলতেই হয় বন্ধু পারভীন সুলতানা রূপা। রূপা নামের রহস্য ব্যাখ্যার জন্যে কারও নিশ্চয়ই শার্লক হোমস হওয়ার দরকার নেই।
আমি বিএসএস পাস করি ১৯৯৭ সালে, তারপর থেকেই মাঝে মাঝে ভাবতাম আসছে ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে ওনার বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা জনিয়ে আসবো। কিন্তু নানা কারণে যাওয়া হয়নি। খালি হাতে যাবো? ফুল মিষ্টি তো লাগবে। অটোগ্রাফ নিতে হলে তো নতুন বইটাও কিনে নিয়ে গেলে ভালো হয়। নানান চিন্তা এসে জড়ো হতো মাথায়।
ঢুকতে দেবে তো? সাহস ফুরিয়ে যেতো। কখনও বা টাকার জোগাড় হতো না। পরে পত্রিকায় তার জন্মদিনের সচিত্র খবর পড়তাম বিষণ্ন মনে। পরে এ পাগলামির সঙ্গে যুক্ত হয় আমার উল্লেখিত বন্ধুটিও। অবস্থা বদলায় না তাতে। দলে ভারি হলে সুবিধা যেমন বাড়ে, বাড়ে সমস্যাও। তার বাসায় কখনই যাওয়া হয়নি আমার। যখন আইনজীবী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালাম তার কিছুকালের মধ্যে (২০১১) পা জোড়াই দাঁড়াবার সক্ষমতা হারিয়ে ফেললো। হুইলচেয়ার হলো চলার অবলম্বন। আর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নানা রকম আশা ও আশংকায় পুরো জাতিকে দুলিয়ে প্রিয় লেখক যাত্রা করেন অনন্তলোকে। ঘাতক কোলন ক্যানসার দেশে-বিদেশে তার কোটি ভক্তের হৃদয়কে করেছে স্বজন হারানোর বেদনায় নীল। আজ তাই খুব মনে পড়ছে সে দিনের সেই বিকেল।
মাঝ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এর এক পড়ন্তবেলা। যথারীতি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অমর একুশে বইমেলা চলছে। প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম কবিতার বই ‘বারবনিতার নাকফুল’। পত্র-পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার, সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। ভাবে আছি চরম! মেলায় হাঁটিও ভাবগম্ভীর ছন্দে। তো সেদিন হঠাৎ মেলায় শোরগোল, হুমায়ূন আহমেদ আসছে। হুমায়ূন আহমেদ আসছে। এদেশের জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে আমার পুরানো। ভেতর থেকে সেটা মাথাচাড়া দেওয়ায় তার নির্ধারিত স্টলের দিকে গিয়ে দেখি বিরাট লাইন। আমি 'কবি' (তখনকার মনোভাব) মানুষ। আমার লাইন ধরার টাইম নাই। এরকম ভঙ্গিতে এগুচ্ছি। পেছন থেকে বেশ গুঞ্জন উঠছে আমি লাইন মানছি না বলে। ওদের পাত্তাই দিচ্ছিলাম না কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে আরও একজন মানুষ আমার কাণ্ড দেখছিলেন। তিনি আর কেউ নন- তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব জনাব ইফতেখার মাহমুদ। তিনি একটু শক্ত করেই ডাকলেন আমাকে। স্যারকে সালাম দিয়ে কুশল জানলাম। স্যার তখন আমার কর্মকাণ্ডে খুব খুশি নন। ক্লাস করি কম, মেলায় সময় দেই বেশি। স্যারকে জানালাম- স্যার আমি অটোগ্রাফ নিতে নয়, অটোগ্রাফ দিতে যাচ্ছি।
তো আরও বেগবান হয়ে আমি প্রবাদপ্রতিম মানুষটার দিকে এগিয়ে গেলাম। লক্ষ্যে পৌঁছে একই প্রশ্ন শুনতে হলো বেশ স্বাস্থ্যবান এক 'হিমু' পোষাকধারী বিক্রয়কর্মীর কাছ থেকে। উপযুক্ত আকারের শ্রোতা পেয়ে সেখানে উচ্চকণ্ঠে প্রায় ঘোষণা করলাম- ‘অটোগ্রাফ নিতে নয়, দিতে এসেছি।’
প্রিয় লেখক তাকালেন আমার দিকে এবং কাছে ডাকলেন। আমি এবার বিনীতভাবে সালাম দিয়ে শুভেচ্ছা বার্তাসহ খসখস ওকালতির প্যাচানো সইটি করে 'ঐতিহাসিক' অটোগ্রাফ ও 'বারবনিতার নাকফুল' বইটি তার হাতে দিলাম। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি হাসমুখে অত্যাচারটি সইলেন এবং বইটি নেড়ে-চেড়ে দেখলেন। আমি দৃশ্যটি শুষে নিচ্ছিলাম যেন, চোখে নয়, মুখে নয়, একেবারে অন্তরাত্মায়। এক বিক্রয়কর্মী বইটি তার হাত থেকে নিয়ে পেছনে রেখে দিতে নিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘বইটা আমার ব্যাগে রাখো। যাওয়ার সময় গাড়িতে দিয়ে দিও।’ আহা! এইটুকু কথার মূল্য কাগজের সন্তান যাদের আলোয় প্রকাশিত হয়েছে কেবল তারাই বুঝবেন।
আমি বইমেলার কবিতার স্টল 'বিশাকা'য় ফিরে এলাম রাজ্য জয়ের আনন্দ নিয়ে, যেখানে অল্প কিছু পাঠক আমার অপেক্ষাতেও ছিলেন।
লেখক: আইনজীবী