গত ৮ অক্টোবর সকালে গাজীপুরের জয়দেবপুরের হাড়িনালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব)। এ সময় র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে দুই জঙ্গি নিহত হয়। প্রায় একই সময়ে হাড়িনালের পাশের পাতারটেকে আরেক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখানে মারা যায় সাত জঙ্গি। সকালে পৃথক অভিযানে টাঙ্গাইলের কাগমারায় অভিযান চালায় র্যাবের অন্য একটি দল। সেখানে মারা যায় আরও দুই জঙ্গি। সন্ধ্যায় আশুলিয়ায় র্যাবের পৃথক আরেকটি অভিযানে পালাতে গিয়ে মারা যায় আরেক জঙ্গি।
র্যাব সূত্র জানায়, গাজীপুরের হাড়িনালের জঙ্গি আস্তানায় র্যাবের অভিযানে যে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে, তাদের একজনের পরিচয় সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তার নাম আমিনুল এহসান। তার বাবার নাম আব্দুল গাফফার মণ্ডল। গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের বেগুনগ্রামে।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, গত বছরের ৪ অক্টোবর বগুড়ার পলিটেকনিক্যালে পড়তে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। এরপর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। গত বছরের ৬ অক্টোবর তার বাবা কালাই থানায় একটি জিডিও দায়ের করেছিলেন। স্বজনরা জানিয়েছেন, আমিনুলের চলাফেরা সন্দেহজনক ছিল। কিন্তু সে যে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে, তা কখনও কল্পনা করেননি তারা।
র্যাব সূত্র জানায়, টাঙ্গাইলের কাগমারায় নিহত দুই জঙ্গির একজন আহসান হাবীব। তার বাবার নাম আলতাফ হোসেন। গ্রামের বাড়ি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামে। পরিবারের সদস্যরা জানায়, ২০০৯ সালে নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়। ২০১৪ সালে অস্ত্রসহ একবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। কয়েক মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর সে আত্মগোপনে চলে যায়। পরিবারের সদস্যরা তাকে খুঁজে না পেয়ে স্থানীয় র্যাব কার্যালয়ে সহায়তা চেয়ে আবেদনও করেছিলেন।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ‘র্যাবের অভিযানে আশুলিয়ায় পালাতে গিয়ে পাঁচ তলা থেকে পড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত ব্যক্তিকে তারা প্রাথমিকভাবে আব্দুর রহমান ওরফে নাজমুল হোসেন হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। জব্দ করা একটি পাসপোর্টের সূত্র ধরে স্থায়ী ঠিকানা সাতক্ষীরা কুশখালীতে খোঁজও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য ভুল ছিল। পাসপোর্টটি আসল না নকল তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।’
র্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ‘আব্দুর রহমান ওরফে নাজমুল হোসেন নব্য জেএমবির অর্থের জোগানদাতা হিসেবে কাজ করতো। তার বাসা থেকে অস্ত্র-গুলি ও এক্সপ্লোসিভসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়েছে। তার স্ত্রীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু সেও প্রকৃত পরিচয় জানাতে পারেনি।’ র্যাবের ওই কর্মকর্তা জানান, ‘কথিত আব্দুর রহমান ওরফে নাজমুল হোসেন তার প্রকৃত পরিচয় আড়াল করে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতো।’
এদিকে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, গাজীপুরের পাতারটেকে তাদের অভিযানে যে সাত জন জঙ্গি মারা গিয়েছে, তাদের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন তারা। এর মধ্যে ফরিদুল ইসলাম আকাশ সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্ধাইল ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ইতলী গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে। ২০১৪ সালে সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেওয়া আকাশের পুরো পরিবারই জঙ্গিকর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গত ৫ সেপ্টেম্বরে আকাশের মা, দুই বোন এবং প্রতিবেশী এক নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। ওই ঘটনার পর থেকে আকাশের বাবা আবু সাঈদ দুই শিশু সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘আকাশ ছিল নব্য জেএমবির ঢাকা বিভাগীয় কমান্ডার। সে নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল। তামিমের নির্দেশনা অনুযায়ী সে শোলাকিয়া ঈদগাহ জামাতে হামলার বিষয়টি সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল।’
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘পাতারটেকে নিহত জঙ্গিদের সবার পরিচয় জানার জন্য ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।’
সিটির ওই সূত্র জানায়, বাকি পাঁচজনের মধ্যে একজনকে তারা গাইবান্ধার আবু শামার ছেলে হাফেজ ছানাউল্লাহ ওরফে হুজুর বলে সন্দেহ করছেন। তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। এছাড়া আরেকজনের সাংগঠনিক নাম ‘মেকানিক’ বলেও জানতে পেরেছেন তারা। তবে তার পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এদিকে, ফেসবুকে তিন জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে র্যাব লিখেছে, ‘আপনারা জানেন, গত ৮ অক্টোবর শনিবার গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ায় র্যাবের পৃথক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হওয়া ৫ জঙ্গির মধ্যে ২ জনের পরিচয় আমরা নিশ্চিত হয়েছে। নিচের ছবির ৩ জঙ্গির পরিচয় জানা জায়নি। এসব জঙ্গির পরিচয় জানতে আপনাদের আশেপাশে অতীতে অবস্থান করছিল, এমন কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যদি ছবিগুলো মিলে যায় অথবা ছবিগুলো আপনার পরিচিত মনে হয়, তাহলে শিগগিরই আপনার নিকটস্থ র্যাব ক্যাম্প অথবা র্যাব সদর দফতরে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হল। বিশেষ প্রয়োজনে +৮৮০১৭৭৭৭২০০৭৫ নম্বরের মোবাইলফোনে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানায় র্যাব।
আরও পড়ুন সন্ত্রাসবাদ দমনে ঢাকা-বেইজিং চুক্তি হচ্ছে
/এমএনএইচ/আপ-এমডিপি