বইমেলায় শিশুদের বই নিয়ে অনেক প্রশ্ন

ছোটদের হরেক রকম বইমেয়েরা হেয়ারপিন পরে সাজবে, ঘোমটা দেওয়া বউ পথ দিয়ে চলবে। অন্যদিকে ছেলেরা ইঙ্ক মানে কালি দিয়ে লিখবে, কুস্তি করবে, ঘোড়া চালাবে। এবারের বইমেলায় শিশুদের অক্ষর শিক্ষার বেশ কিছু বইয়ে এভাবে ছেলে-মেয়েদের কাজের ভিন্নতা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, শিশুদের মনে লিঙ্গ বৈষম্য ঢুকিয়ে দিতে কাজ করছে এ ধরনের বই।

অভিযোগ আছে আরও। অসংখ্য বানান ভুল, মানহীন ছড়া, নিম্নমানের ইলাস্ট্রেশন আর অসংলগ্ন প্রচ্ছদে ভরা এসব বই শিশুদের উপযোগী কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকরা। অনেক লেখক, প্রকাশক ও অভিভাবকের মতে, শিশুদের বইয়ে বিশেষ করে বানান ভুল শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

শিশুদের বই কেনা নির্বিঘ্ন করতে কয়েক বছর ধরে শুক্র ও শনিবার বইমেলায় শিশু প্রহরের ব্যবস্থা করা হয়েছে, রাখা হয়েছে শিশু কর্নার। কিন্তু শিশুদের বইয়ের মান বাড়ানোর কোনও উদ্যোগ নজরে পড়েনি। ঝিঙেফুল, কিশোর ভুবন, শিশুসাহিত্য বইঘর, ছোটদের বই -এসব প্রতিষ্ঠানের বই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। শব্দশিল্প, শৈশব প্রকাশ, পাতাবাহার, পিপিএমসি প্রতিষ্ঠানের বই বরং তুলনামূলক ভালো। স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোও অবশ্য শিশুতোষ বই প্রকাশ করে থাকে। এসব বইয়ের মান তুলনামূলক ভালো হলেও চড়া দামের কারণে বেশিরভাগ দর্শনার্থীই বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন, কিন্তু কিনছেন না।

ঘোমটা পরা বউ পথে চলেবইমেলায় ৭ বছরের শিশুকে নিয়ে এসেছেন ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদুন নবী। শিশুটির হাতে কয়েকটি কার্টুনের বই। বইগুলো শিশুটি নিজে পছন্দ করে কিনেছে উল্লেখ করে রাশেদুন নবী বলেন, ‘ও এখনও পড়তে শেখেনি, আমরাই পড়ে শোনাব। ভিতরের কনটেন্ট ভীষণ দুর্বল। কিন্তু বইয়ের প্রচ্ছদে অযথা আকর্ষণীয় কার্টুন থাকায় এই বইগুলোই সে কিনবে। এটা এক ধরনের প্রতারণা।’ 

এসব বইয়ের দাম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএলের ‘মধু শিকারী’ বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা খুব বেশি না হলেও বইটির দাম রাখা হয়েছে ৮০০ টাকার ওপরে। বইটির ইলাস্ট্রেশন ভালো এবং পৃষ্ঠা আকারে বড় হলেও এ দামকে উপযুক্ত মানতে নারাজ অভিভাবকরা।

ভুলে ভরা বই যে কতটা বিপজ্জনক, প্রকাশক ও কবি লিলি হক তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বই সব সময়ের বন্ধু। শিশুর হাতে  ভুল বই তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার ভবিষ্যতকে শঙ্কায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সে ভুলের মধ্য দিয়ে বই পাঠের অভ্যাস করছে।’

তাক ডুমাডুম ঢোল বাজেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব মীরও এ নিয়ে শঙ্কিত। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ- এটা আজ বুলি সর্বস্ব। বইমেলায় গেলেই এটা বোঝা যায়। ভুল বানানে লেখা,  কোনও পরিকল্পনার ছাপ না থাকা বই বের হচ্ছে। তার ওপরে বইয়ের চড়া দাম। এসব বই কারা বের করছে, কে লিখেছে কিছুই লেখা থাকে না। ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে যা খুশি তা দিয়ে বই বের হচ্ছে।’

প্রকাশকদের অনেকেও এ ব্যাপারে একমত। তাদের মতে, চাহিদা থাকলেও শিশুদের উপযোগী বইয়ের লেখক এবং সার্বিক পরিকল্পনা দুটোরই অভাব রয়েছে। এ দুটোর সমন্বয়ের অভাবে এমন অনেক কিছু প্রকাশিত হচ্ছে, যা হয়তো মানসম্পন্ন নয়।

P_20170209_174315শিশুদের বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ঘাস ফড়িং’ এর স্বত্ত্বাধিকারী নির্জনা রত্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুদের ছবির প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে। কনটেন্টে মনোযোগ না দেওয়ার প্রবণতা হয়তো আছে, তবে বইয়ের সার্বিক মান ভালো করার সুযোগও আছে।’    

একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সেলিমা রহমান ‘ভি-তে ভেইল পরে বউ পথে চলে’ লেখা নিয়ে শঙ্কিত। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছেলে ও মেয়ে শিশুর কাজের  ধরনের যে পার্থক্য বইতে শেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, সেটি জেণ্ডার অসংবেদনশীল সমাজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। বিষয়টি শঙ্কার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাবেরী গায়েন এখানে দুই ধরণের সমস্যা দেখছেন। তার ভাষ্য, ‘প্রথমত, বর্ণ পরিচয়ের বইতে ইংরেজি শব্দ অথচ বাক্যটি বাংলায়। যেমন- Veil পরা বউ পথে চলে, খুকুর মাথায় hairpin, Mirror নিয়ে খুকু সাজে, Ink দিয়ে লিখতে পারি, Horse এ চড়ে যাচ্ছে খোকা। এমন উদ্ভট বর্ণ পরিচয়ের বই কখনও দেখিনি। দ্বিতীয়ত, জেন্ডার সংবেদনশীলতা। মেয়ে শিশুকে এভাবে সাজগোজকারী এবং ছেলে শিশুকে ভ্রমণকারী দেখানোর জেন্ডারবিভক্তির প্রতিবাদ জানাই।’

যোগ করে কাবেরী গায়েন আরও বলেন, ‘এসব বই বাংলা একাডেমির মেলায় আসতে পারে কারণ বইমেলার এতো বছরেও কোনও সম্পাদনা পর্ষদ তৈরি হয়নি। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করলো কিনা, এটা দেখাই একমাত্র বিবেচ্য হয়েছে বাংলা একাডেমির।’

/এএআর/জেএইচ/আপ-এপিএইচ/