হাসপাতালে ঘুরে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতলটি উদ্বোধন করেন। হাসপাতালটি ৯ দশমিক ৫২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পুরো প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ছিল ১১০ কোটি টাকা। রাজধানীর উত্তরে মুগদা, মানিকনগর, সায়েদাবাদ, ধলপুর, গোবিন্দপুর, রায়েরবাগ এবং দক্ষিণে বাসাবো, মাদারটেক, খিলগাও, শাহজাহানপুর, নন্দীপাড়া, নাসিরাবাদ, দক্ষিণগাঁও, ত্রিমোহনি, রামপুরা, বনশ্রী এলাকার ন্যূনতম ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ মানুষের জন্য নির্মিতি এই হাসপাতাল।
এলাকার বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে নিজেদের এলাকা ছেড়ে অন্য কোনও হাসপাতালে যেতে না হয় সেজন্যই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে হাসপাতালটি স্থানীয় মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসা নিতে আসা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে। প্রায় চার বছর এই হাসপাতাল প্রকাণ্ড ভবন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব যায়নি।
হাসপাতালটির টিকেট কাউন্টার থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন বর্হিবিভাগে রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৭০০ থেকে তিন হাজার এর ওপরে ছাড়িয়ে যায়। আর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আসেন প্রতিদিনই প্রায় এক হাজারের ওপরে। এই বিপুল সংখ্যক চিকিৎসা প্রার্থীদের জন্য হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয় লোকবল। যার কারণে রোগীরা ঠিকমতো চিকিৎসা পান না।
হাসপাতাল থেকে জানা গেছে, প্যাথলজি বিভাগে কয়েকদিন পরপরই হাউকাউ লেগে যায়। কারণ, তিন-চার জন মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না কয়েকশ’ মানুষের রিপোর্ট প্রতিদিন সময়মতো দেওয়ার।
হাসপাতাল ঘুরে জানা যায়, এখানে ওয়ার্ড বেড ৩৬০, আর কেবিন রয়েছে ১৬০টি। আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) রয়েছে ১০টি বেড। এছাড়াও রয়েছে এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট), সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট) ও অন্যান্য বিভাগসহ ২০টি আলাদা বিভাগ। তবে এসব বিভাগে নেই পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। রয়েছে টেকনোলজিস্ট সংকট ও নার্সের ঘাটতি। পাশাপাশি তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ঘাটতিও রয়েছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা।
হাসপতাল সূত্রে জানা গেছে, এখানে আইসিইউ, সিসিইউ চালু থাকলেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক এবং নার্স নেই। নিজেদের উদ্যোগে ঢাকার আরও কয়েকটি হাসপাতালের আইসিইউ, সিসিইউ থেকে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন এই হাসপাতালে কাজ করে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি অ্যান্ড অবস, শিশু বিভাগ, গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি, নাক-কান-গলা, চক্ষু বিভাগ, নেফ্রোলজি, ফিজিওথেরাপি, অর্থোপেডিকস, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি, ইউরোলজিসহ প্রায় ২০টি বিভাগ থাকলেও প্রায় বেশিরভাগ বিভাগেই নেই প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বর্তমানে এখানে ১৬২জন চিকিৎসক থাকলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কম। প্রতিটি বিভাগে আরও তিনজন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার আবেদন করলেও সে বিষয়টি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
অন্যদিকে, এই হাসপাতালে নার্সের পদ রয়েছে ১৯৫টি। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে প্রেষণে রয়েছেন ২৫ জন। যদিও তারা এই হাসপাতালে ডিউটি না করেই বেতন পাচ্ছেন এই হাসপাতাল থেকে। নার্সিং সুপারভাইজার রয়েছেন নয় জন, যদিও পদ রয়েছে ১০ জনের।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিএসসি নার্সিং পড়তে গিয়েছেন ২২ জন। আর চলতি বছরে সুযোগ পেয়েছেন আরও ২০ জন। নার্সিং সেক্টরে বিশাল এই ঘাটতি রোগীদের সীমাহীন ভোগান্তি ও দূর্ভোগে ফেলতে বাধ্য করেছে বলেও জানিয়েছেন হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে চাকরি করে সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারি না। কমপক্ষে এই হাসপাতালে আরও ১০০ জন নার্স দরকার।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নিজেও এ বিষয়টি জানেন। তিনি গত বছর হাসপাতাল ভিজিটে এসে বলেছিলেন, ‘হাসপাতালের প্রয়োজনীয় নার্স নিয়োগ দেওয়া হবে।’ কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।
হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি সংকটের কথা স্বীকার করেছেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. আজিজুন নাহার। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বিভাগের জন্য অন্তত আরও তিন জন করে মোট ৬০ জন চিকিৎসক হলে কিছুটা চিকিৎসক সংকট দূর হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেফ্রোলজি বিভাগে একজন মাত্র সহযোগী অধ্যাপক। বার্ন ইউনিটের জন্য নেই সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক কিংবা কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনজন মেডিক্যাল অফিসার আর সার্জারি বিভাগের সাহায্যেই চলছে এই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। অথচ এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চাপও কমে যেতো।
/এসএমএ/