অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন রাস্তা ও ফুটপাত সংস্কার এবং আধুনিকায়নের জন্য বিভিন্নভাবে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতে সংস্থার ৫নং অঞ্চলের ৪৫নং ওয়ার্ডের জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিস্টিলারি রোড ও দীননাথ সেন বাইলেনের কোকা-কোলার গলির পাইপ, নর্দমা নির্মাণসহ রাস্তা ও ফুটপাতের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের বিপরীতে তিনটি গ্রুপে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এতে ৪৫নং ওয়ার্ডের পাইপ ও নর্দমা নির্মাণসহ রাস্তা ও ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিস্ট্রিলারি সড়কের ১০৭নং হোল্ডিং থেকে ২১/ঙ পর্যন্ত এবং ১২৬নং হোল্ডিং থেকে ১১৯/১৩ কাঠেরপুল পর্যন্ত রাস্তায় ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণ কাজ। এ কাজের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ১২৯ টাকা।
কাজটিতে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে এমন অভিযোগ ওঠার পর মেয়র সাঈদ খোকন বিষয়টি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে দেখা যায়, একই রাস্তার বিপরীতে দু’টি কার্যাদেশ দেওয়া ছাড়াও আধুনিকায়নের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছে তাও প্রায় দ্বিগুণ। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ কাজের সর্বোচ্চ প্রাক্কলন ব্যয় ধরা যেত এক কোটি ২১ লাখ ৪৬ হাজার ১৮ টাকা। এতে অতিরিক্ত ২ কোটি ৭৭ লাখ ৫৪ হাজার ১১১ টাকা ধরা হয়েছে।
শুধু তায় নয়, একই রাস্তার হোল্ডিং নম্বর পরিবর্তন করে আরও একটি প্রকল্প তৈরি করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ডিস্টিলারি রোডের ১৫৭নং হোল্ডিং থেকে ৭৬নং পর্যন্ত এবং ২১ থেকে ১০২নং ধূপখোলা রোড পর্যন্ত আলাদা কাজ ধরা হয়। তবে কাজের প্রকৃতি এক ও অভিন্ন রাখা হয়। এ সড়ক দু’টি মূলত একটি সড়ক। একই সড়কের ১১৬নং হোল্ডিং থেকে উত্তর দিকে দয়াগঞ্জ রোড পর্যন্ত দৈর্ঘ্য বাস্তবে ১৬৫ মিটারের স্থলে নকশা ও প্রাক্কলনে ২৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৪ দশমিক ৫০ মিটারের স্থলে ৯ মিটার দেখানো হয়েছে। এছাড়া, পাইপের ডায়া, পিটের গভীরতা, ব্রিক ওয়ার্কে প্রস্থসহ আরও কিছু বিষয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এজন্য ব্যয় ধরা হয় ৪ কোটি ৯৮ লাখ ৭ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, কাজ না করেই এই টাকার পুরোটা আত্মসাতের পাঁয়তারা করে চক্রটি।
জানা গেছে, সাঈদ খোকন কাজটি শুরুর আগেই করপোরেশনের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করেন। এসময় এ কাজের দায়িত্বে ছিলেন অঞ্চল-৫-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হোসেন। তাকে অঞ্চল-১-এ বদলি করা হয়। ২নং অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী বোরহান আহমেদকে বদলি করা হয় অঞ্চল-৫-এ।
বোরহান আহমেদ এ কাজের দায়িত্ব নিয়েই লুটপাটের চিত্র দেখতে পান। অন্যদিকে, মুন্সি আবুল হাশেম আগেই কার্যাদেশ দেওয়ায় ঠিকাদাররা কাজ শুরুর জন্য বোরহান আহমেদের অনুমতির জন্য জোড়াজুড়ি করতে থাকেন। ঠিকাদারদের তিনি কাজ করতে না দিয়ে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানান। এক পর্যায়ে বিষয়টি মেয়র সাঈদ খোকনের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। এই প্রকল্প ছাড়াও নর্দমা নির্মাণের আরও একটি কাজেও ধরা পড়ে অসামঞ্জস্য।
ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এ তিনটি কাজে সিটি করপোরেশনের ৭ কোটি টাকারও বেশি লুটপাটের পরিকল্পনা ছিল একটি চক্রের। কাজ না করেই তারা পুরো টাকা আত্মসাতের চিন্তা চিল তাদের। কিন্তু মেয়র সাঈদ খোকন পর্যন্ত গড়ানোয় তা আর সম্ভব হয়নি।
এই তিনটি প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন ডিএসসিসির চার প্রকৌশলী। তারা হলেন— অঞ্চল-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাশেম, অঞ্চল-২-এর সহকারী প্রকৌশলী (পুর) পারভেজ রানা, অঞ্চল-৫-এর সহকারী প্রকৌশলী আতিক উল্যাহ মৃধা ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পুর) মো. ফরিদুজ্জামান। এদের তিন জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় মামলা ও একজনের বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে।
মামলার চূড়ান্ত রায়ে মুন্সি আবুল হাশেমকে আগামী ছয় মাস কোনও পদোন্নতি দেওয়া হবে না মর্মে চাকরিতে পুনঃবহাল করা হয়। বাকি তিন জনকে আগামী এক বছর কোনও পদন্নোতি না দেওয়ার শর্তে পুনঃবহাল করা হয়। সবার অগোচরেই গত ১৩ মার্চ এই কর্মকর্তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ডিএসসিসি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানকে একাধিক বার ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি। বক্তব্য চেয়ে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনও উত্তর দেননি তিনি।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা এ শাস্তিকে হাস্যকর বলে মনে করছেন। কারণ অতীতে ৫-১০ বছর পর্যন্ত কোনও কর্মকর্তার পদোন্নতি হওয়ার নজির নেই। আর এই শাস্তি না দিলেও এই কর্মকর্তাদের আগামী ৬ মাস বা ১ বছরের মধ্যে পদোন্নতি পাওয়া সম্ভাবনা নেই। ফলে এই শাস্তিতে প্রকৃত অর্থে কোনও শাস্তি মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই শাস্তি একদম নামেমাত্র শাস্তি। এ ধরনের উদাহরণ দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির সচিব মো. শাহাবুদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। বিষয়গুলো বুঝে উঠতে আমার আরও কিছুদিন সময় লাগবে।’
সংস্থার সহকারী সচিব-১ মোহাম্মদ আরশাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও কর্মকর্তার শাস্তি তদন্তকারী কর্মকর্তার চার্জশিট অনুযায়ী হয়। এতে কার কী অপরাধ তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকে। এরপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশই বাকি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’
আরও পড়ুন-