ভাই কইছিল, এবার ঈদে বাড়িতে আসবে, একসঙ্গে ঈদ করমু আমরা। কিন্তু ভাই আমার কই গেলো, লাশঘরে ভাইরে রাইখ্যা কোন বইন পারে ঈদ করতে?’ এভাবে আহাজারি করছিলেন গুলশান হামলায় নিহত সাইফুল চৌকিদারের বড়বোন মায়া বেগম।
হলি আর্টিজান হামলার এক বছর পর সেই ঘটনা কাভার করার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলেন মায়া বেগম আর কানে বাজলো তার সেই আহাজারি। তিনি বলছেন, ‘আমার ভাই সাইফুল জঙ্গি ছিল না, তার সঙ্গে জঙ্গিদের কোনও মিল নাই। তারা ভুল কইরা আমার ভাইরে মাইরা এখন জঙ্গি বানাইতাছে। আমাদের পরিবারকে জঙ্গি পরিবার বানাইছে, ভাইরে ফিরত পামু না, কিন্তু আমরা সরকারের কাছে এর ক্ষতিপূরণ চাই, তাদের কাছে জবাব চাই।’
সেদিন ছিল শুক্রবার। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাসার কাছাকাছি যেতেই মায়ের ফোন কল, ‘তুমি কোথায়, গুলশানে হামলা হয়েছে, টিভিতে দেখাচ্ছে।’ আমি বাসার কাছেই বলে তাকে আশ্বস্ত করলাম, তখনও বুঝতে পারিনি কী অপেক্ষা করছে, কী হচ্ছে গুলশানে। ঘরে ফিরেই টিভিতে দেখলাম, সেদিন টিভিতে দেখাচ্ছিল সবকিছু।
এরপর ধীরে ধীরে সে রাতটা এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে—যা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা, আহত হয়েছেন পুলিশসহ অর্ধশত মানুষ। ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ন্যাক্কারজনক দিন হিসেবেই মানুষ স্মরণ করবে।
রাতে পুরোটা সময়ই কেটেছে টিভি সেটের সামনে আর মোবাইল ফোনে বাংলা ট্রিবিউন দেখে। সব জায়গাতেই দেখছিলাম সে রাতের ভয়াবহতা।
নির্ঘুম রাত পোহালে ভোরের দিকেই অফিস থেকে ফোন, যেতে হবে স্পটে। মনে হলো যেন এমন একটা ফোনকলের অপেক্ষাতেই ছিলাম। তৈরি হয়ে সিএনজি নিয়ে ছুট দিলাম। গুলশান থেকে ডিওএইচএস বাড়িধারার প্রবেশমুখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিএনজি থামিয়ে দিল, বলা হলো হেঁটে যেতে হবে। নেমে হাঁটতে শুরু করতেই দেখলাম, সে সকাল ভয়ার্ত, মানুষ হাঁটছে আর কথা বলছে হামলা নিয়ে। তখনও কেউ কিছু পরিষ্কার করে জানে না, কেবল জানে লেকপাড়ের ঐ রেস্টুরেন্টে জঙ্গিরা আক্রমণ করেছে। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পাচ্ছিলাম গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ।
সেদিনের খবরগুলো ছিল আমাদের দুই থেকে তিন লাইন করে, কিন্তু এসব টুকরো খবরই গুলশান হামলার ব্যাপারে জানান দিচ্ছিল সবকিছু।
আর একটি কথা বলতে চাই, সেদিন আশেপাশের প্রতিটি ভবনের বাসিন্দারা সাহায্য করেছেন গণমাধ্যমকর্মীদের। ফোন চার্জে দেওয়া, পানি খাওয়ানো, টয়লেটে যাওয়ার সুবিধা সবই পেয়েছি আমরা তাদের কাছ থেকে।
সকাল এগারটা চল্লিশ মিনিটে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির কম্পাউন্ডের ভেতরে সিআইডির ক্রাইম সিন ভ্যান প্রবেশ করেছে।
হঠাৎ করেই চিৎকার শোনা যায় আফতাব বহুমুখী ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার খানের। দৌড়াচ্ছেন তিনি, ফোনে কাউকে বলছেন, তাহমিদ বেঁচে আছে, পুলিশ তাকে নিয়ে যাচ্ছে ডিবি কার্যালয়ে, আমিও সেখানেই যাচ্ছি। তার পাশে থেকেই শোনা গেল তিনি ফোনে কাউকে বলছেন, ‘কাঁদছো কেন, ছেলেতো বেঁচে আছে।’
চোখের সামনে দিয়ে বেলা ১২টা ১০ মিনিটে নিহতদের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সগুলো বের হয়ে যায়। এর আগে অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
কেবল হামলার পরদিনই নয়, গুলশান হামলার রেশ ছিল আরও বেশ কিছুদিন। সিএমএইচে পাঁচ জঙ্গিসহ নিহতদের ময়নাতদন্তও কাভার করেছি। জেনেছি, নারীদের প্রতি বেশি নৃশংস ছিল হামলাকারীরা।’
এই জঙ্গি হামলায় তাহমিদ বেঁচে থাকার খবরে তার বাবার উচ্ছ্বাস যেমন একদিকে দেখেছি, তেমনি দেখেছি অবিন্তা কবিরের মায়ের চোখে ওড়না চেপে কান্নার দৃশ্য—জেনেছি একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে নীরব হয়ে গেছেন তিনি; দেখেছি মোবাইলে ভাইয়ের ছবি হাতে মায়া বেগমের কান্না—জেনেছি যে ঈদ তাদের একসঙ্গে করার কথা ছিল সেটি আর কোনওদিনই হয়নি, কখনোই আর ভাইকে নিয়ে ঈদ করা হবে না মায়া বেগমের।
/টিএন/
আরও পড়ুন: