বাস্তবের আয়নাবাজি আদালতে ধরা

হাইকোর্টআইন-আদালতের নজর এড়িয়ে প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে জেল খাটেন অন্যজন। এমন গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়েছে এই দেশে। ‘আয়নাবাজি’ নামের সেই সিনেমার মতো বাস্তবেও এমন ঘটনার দেখা মিললো এবার। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে রিট আবেদনের শুনানিতে এমন একটি ঘটনা ধরা পড়ে। বুধবার (১৯ জুলাই) শুনানি শেষে  বিচারপতি একেএম আব্দুল হাকিম ও এসএম মজিবুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত দু’জনকেই কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
মামলা ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি সেজে জেল খাটতে যান মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চক পালপাড়া গ্রামের আরজ খানের ছেলে আরিফ খান। মূল আসামি একই গ্রামের মৃত আমির উদ্দিনের ছেলে আয়নাল হক।

মামলার বিবরণে জানা যায়, আসামি আয়নাল হকের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২৮ জুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সিংগাইর থানায় একটি ধর্ষণ মামলা করা হয়। মামলার অভিযোগে ঘটনার তারিখ উল্লেখ করা হয় ২০০৩ সালের ৯ ডিসেম্বর। এ মামলার তদন্ত শেষে সিংগাইর থানা পুলিশ আয়নাল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। বিচার শেষে ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি মানিকগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আসামি আয়নাল হককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এ সময় আয়নাল হক মালয়েশিয়াতে ছিলেন তিনি। আদালত রায়ে তাকে পলাতক দেখিয়ে সাজা দেন।

এ রায়ের পর আয়নাল হক সেজে একই গ্রামের আরিফ খান ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ আদালতে আত্মসমর্পন করেন। পরে ২০১৪ সালে ওই রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে কোয়াশমেন্ট (বাতিল) আবেদন করেন আরিফ খান। এ আবেদনে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এরও কিছুদিন পর আরিফ খানের মা আলেয়া বেগম তার ছেলের মুক্তির জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। তার ছেলে আরিফ খানকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছে দাবি করে এ আবেদন করা হয়। এ আবেদনের পর হাইকোর্ট বিষয়টি তদন্ত করে পুলিশ প্রশাসনকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু আদালতে পুলিশের প্রতিবেদন না আসায় ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল হাইকোর্ট তাকে ছয় মাসের জামিন মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি রুল জারি করেন। এরপর আরিফ খান কারাগার থেকে মুক্তি পান। আবেদনটি বিচারাধীন রয়েছে।

আরিফ খান জামিনে মুক্তির পর আয়নাল হক ২০১৫ সালের ৫ জুন মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসেন। এরপর ৯ জুলাই আদালতে আত্মসমর্পন করেন। সেই থেকে তিনি কারাগারে। এরপর তিনি সাজা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে কোয়াশমেন্ট আবেদন করেন। আদালত রুল জারি করেন। এ মামলা বতিলের আবেদ বিচারাধীন রয়েছে। এই আবেদনে জারি করা রুলের শুনানির সময় বদলি সাজা খাটার ঘটনাটি আদালতের চোখে ধরা পড়ে।

পরে হাইকোর্ট দুই আসামি আয়নাল হক ও আরিফ খান এবং আরিফ খানের মা আলেয়া বেগমকে তলব করেন। এ নির্দেশে আয়নাল হককে গত ৩ জুলাই কারাগার থেকে হাইকোর্টে হাজির করা হয়। আদালত তার বক্তব্য শোনেন। এরপর ১২ জুলাই আলেয়া বেগম হাইকোর্টে হাজির হয়ে বক্তব্য দেন। এ অবস্থায় আরিফ খানকেও হাজির করা হয়। আরিফ খান আদালতকে জানান, নগদ দুই লাখ টাকা এবং বিনা টাকায় মালয়েশিয়ায় নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আয়নাল হক সাজিয়ে আত্মসমর্পন করানো হয় তাকে।

বুধবার (১৯ জুলাই) আদালত সব পক্ষের বক্তব্য শোনেন। বক্তব্য শেষে আরিফ খান ও তার মা আলেয়া বেগমের আবেদনে জারি করা রুল খারিজ করেন আদালত। আর আয়নাল হকের আবেদনে জারি করা রুলের ওপর আগামী ২৬ জুলাই শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত।

জালিয়াতি উদঘাটনের পর আদালত আরিফ খান ও ধর্ষণ মামলার মূল আসামি আয়নাল হককে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সিংগাইর থানার ওসিকেও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।  বুধবার (১৯ জুলাই) বিচারপতি একেএম আব্দুল হাকিম ও এসএম মজিবুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে আসামি আয়নাল হকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া তাকে সহযোগিতা করেন আজমিনা বেগম ও কামরুন্নাহার সীমা। আরেক আসামি আরিফ খানের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ মিয়া। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হারুন-অর-রশিদ।

প্রতারণার মাধ্যমে বদলি সাজা খাটা ও জামিন নেওয়ার এ ঘটনাকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হারুন-অর-রশিদ জঘন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দালত এ ধরনের ঘটনাকে বিচার বিভাগের জন্য হুমকিস্বরূপ।’

আলাদত এ ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ জাতীয় ঘটনা প্রতিরোধ করতে না পারলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সঠিক ধারণা পাবে না। টাকা-পয়সা দিয়ে এভাবে কেনাবেচা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

/এমটি/এসএমএ/