কেবল বিরল রোগে আক্রান্ত মুক্তামনিই নয়, বৃক্ষমানব হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাওয়া আবুল বাজানদার, মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়া, ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া শিশু, জোড়া শিশু তোফা ও তহুরার সফল অস্ত্রোপচারের সাফল্য দেশ ছাড়িয়ে স্থান পেয়েছে বিদেশি গণমাধ্যমেও।
হাত না কেটে অস্ত্রোপচার করাকে চিকিৎসকরা দেখছেন সফলতা হিসেবেই। অস্ত্রোপচার শেষে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘অপারেশন সফল, মুক্তামনি ভালো আছে। প্রাথমিক সাফল্য বললেও এটা এখানেই শেষ নয়, তবে আমরা সফল হবো।’
অন্তত ত্রিশজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম। তার সঙ্গে ছিলেন একই ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন, অধ্যাপক সাজ্জাদ খোন্দকার, অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল, সহযোগী অধ্যাপক ডা. লুৎফর কাদের লেনিন, সহযোগী অধ্যাপক ডা. সালমা আনাম, সহকারী অধ্যাপক ডা. তাহমিনা সাত্তার,সহকারী অধ্যাপক রবিউল করিম খান, সহকারী অধ্যাপক ডা. শরীফ আশফিয়া রহমান, সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, সহকারী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হেদায়েত আলী খান, সহকারী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস, সহকারী অধ্যাপক ডা. সালেক বিন ইসলাম, বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন হোসাইন ইমাম, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবু ফয়সাল মো. আরিফুল ইসলাম নবীন ও ডা. শারমিন আক্তার সুমি, সহকারী রেজিস্ট্রার ডা.মাহবুব হাসান ও ডা. নুরুন নাহার লতা।
ছিলেন বার্ন ইউনিটের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবীর, সহকারী অধ্যাপক ডা. মলয় কুমার দাস, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মৌমিতা তালুকদার, ডা. রেবেকা সুলতানা ও ডা. মো. আনিসুর রহমান। ঢামেক হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোজাফফর হোসেনসহ সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাবেয়া বেগম, সহকারী অধ্যাপক ডা. সুব্রত কুমার মণ্ডল ও ডা. তানভীর আলম এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শফিকুল আলমও ছিলেন।
এছাড়াও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের অ্যানেসথেসিয়া অধ্যাপক ডা. নরেশ চন্দ্র মণ্ডল ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মকবুল হোসেনও উপস্থিত ছিলেন।
২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরায় যুবলীগের সংঘর্ষে মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয় সুরাইয়া। ওইদিন রাতেই মাগুরা সদর হাসপাতালে অপারেশন হয় সুরাইয়ার মা নাজমা বেগমের। সন্তান প্রসবের পর দেখা যায় পেটে থাকা শিশুটিও গুলিবিদ্ধ। দু’দিন পর মা ও নবজাতককে ভর্তি করা হয় ঢামেক হাসপাতালে। গঠিত হয় ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড।
নবজাতক বিভাগের আইসিইউতে রাখার পর একটু আশঙ্কামুক্ত হলে মায়ের কোলে শিশুটিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, নাম রাখা হয় সুরাইয়া। ঢামেক হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল হানিফ টাবলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুরাইয়ার চিকিৎসা আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা।’ মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে হাতেগোনা আরও কয়েকটি ঘটেছে জানিয়ে আব্দুল হানিফ টাবলু বলেন, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা দুই/একটি হলেও তারা বাঁচেনি। মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র শিশু সুরাইয়াই। বিশ্বে এই ঘটনা এটিই প্রথম।’
সুরাইয়ার চিকিৎসা করা মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য নবজাতক বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা, বর্তমান প্রধান অধ্যাপক ডা.আশরাফুল হক কাজল ও অধ্যাপক ডা.কানিজ হাসিনা শিউলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সুরাইয়া এখন ভালো আছে। তবে তার বিষয়টি এখনও আমাদের কাছে বিস্ময়, কী করে সে এতোটা সারভাইভ করতে পারে! এই বিষয়গুলো আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, পুরো দেশ আমাদের সঙ্গে থাকে, যেটা আত্মবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন,‘সুরাইয়া যখন অধ্যাপক শিউলির অধীনে ভর্তি হয়,তখন কিছু জটিলতা ছিল। তখন আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি, একমাস একদিন সে আমাদের কেয়ারে ছিল, প্লাস্টিক সার্জারি, পেডিয়াট্রিক সার্জারি– সবাই মিলে প্রতিদিন তার জন্য কাজ করতাম, আমাদের এই একাগ্রতা ছিল সুরাইয়াকে সুস্থ করে তোলার জন্য। সবাই যে যার অবস্থান থেকে তার সর্বোচ্চটুকু দিয়েছিলেন।’
সফল এ অপারেশনে যুক্ত ছিলেন প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক আবুল কালাম, ডা. তানভীর আহমেদ, ডা. লতা, ডা. গোবিন্দ, ডা. ফয়সাল ও ডা. হেদায়েত, নিউরোসার্জন অধ্যাপক অসিত চন্দ্র সরকার, ডা. রাজিউল হক, অর্থোপেডিক সার্জন অধ্যাপক শামসুজ্জামান, পেডিয়াট্রিক সার্জন ডা. শাহনুর ইসলাম, ডা. মোহাম্মদ মইনুল হক, অধ্যাপক আশরাফ উল হক কাজল, অধ্যাপক সামিদুর রহমান, অধ্যাপক কানিজ হাসিনা শিউলি, অধ্যাপক আবদুল হানিফ টাবলু। অ্যানেসথেশিয়ায় ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, ডা. রাবেয়া, ডা. শফিকুল আলম ও ডা. আতিক। এছাড়াও ছিলেন পেডিয়াট্রিক সার্জন তাহমিনা হোসেন, ডা. আল মাসুদ, ডা.পার্থ সারথি মজুমদার,ডা. গাফফার খান জিয়া, ডা. সনেট, ডা. কৌশিক ভৌমিক ও ডা. তাসনিম আরা।
আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা.এবিএম আব্দুল্লাহ রচিত ৬টি বই উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে।
দেশের অন্যতম জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে একজন সিনিয়র মোস্ট হিসেবে বলতে পারি, আগে আমরা যেভাবে চিকিৎসা করতাম, দিনে দিনে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, আরও হচ্ছে। তার প্রমাণ আবুল বাজানদার। বিশ্বে যে ক’জন বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল তাদের কারও এত সফল অস্ত্রোপচার হয়নি–এটি আমাদের জন্য একটি মাইলফলক। অপরদিকে, তৌফা-তহুরার যে অপারেশন হয়েছে, এটি দশ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না-অথচ সেটাই সম্ভব করেছেন আমাদের চিকিৎসকরা।’ চিকিৎসকদের সাফল্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শিশুদের অজ্ঞান করার মতো সাহস কারও ছিল না-অথচ তাদের একসঙ্গে রেখে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করাটাই বলে দেয় বাংলাদেশের চিকিৎসকরা কোথায় পৌঁছে গেছেন। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের চিকিৎসকরা যদি ভালো টেকনোলজিক্যাল সাপোর্ট পান, তারা নিঃসন্দেহে আরও উন্নতি করবে। কারণ, তাদের মেধা রয়েছে, ইচ্ছা রয়েছে। রোগীদের প্রতি আন্তরিকতা রয়েছে। চিকিৎসকের এই বিষয়গুলো অনুপ্রেরণা দেবে পরবর্তী প্রজন্মকে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের চিকিৎসা যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে আমরা একদিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাবো।’
অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের ভুল হলে যতোটা ফলাও করে প্রচার করে সংবাদমাধ্যম, সে তুলনায় বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সাফল্য নিয়ে সংবাদ কমই দেখি। আমাদের সাফল্যকে একেবারেই খাটো করে দেখার মতো নয়, কারণ সাম্প্রতিক সময়েই বেশি কিছু চিকিৎসা বাংলাদেশে হয়েছে, যেটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করেছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন করে উচ্চারিত হয়েছে।’
/জেএ/এএম/আপ-এসএনএইচ/