সকালে কীর্তনের সুর দিয়ে শুরু হয় লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনের আসর। এরপর আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ কক্ষে শুরু হয় উইলিয়াম ডালরিম্পলের সেশন। সাজিয়া ওমরের সঞ্চালনায় ডালরিম্পল তার প্রথম তিন ভ্রমণ কাহিনী থেকে পড়ে শোনান ও আলাপ করেন।
আর সবার মতো ডালরিম্পলও ভ্রমণ করতে ও ভ্রমণ কাহিনী পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন। এখান থেকেই ঘোরাঘুরি শুরু করেন ও ভ্রমণ কাহিনী লেখেন। আলোচনার এক ফাঁকে জানালেন অচিরেই আসছে তার রচিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস নিয়ে একটি বই। সেখানে থাকছে বাংলাদেশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।
সকালে দুই বাংলার সম্পর্ক নিয়ে সম্পর্কের এপার-ওপার শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন- বিভাস রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান খান, শাহীন আখতার, সাজ্জাদ শরীফ ও আহমেদ রিয়াজ। বক্তাদের কথায় উঠে আসে ভৌগলিক সীমারেখা কখনোই দুই বাংলার সম্পর্ককে ভাগ করতে পারবেনা।
সকাল থেকেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে উপস্থিতিদের একটাই জিজ্ঞাসা ছিল হার স্টোরিজ সেশনটি কখন। রোকেয়া সুলতানার ইলাস্ট্রেশনে ২১ দিগ্ববিজয়ী নারীর গল্পগাঁথা নিয়েই রচিত হয়েছে ‘হার স্টোরিজ’। বিকেলে হওয়া এই সেশনে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিউতি সবুরের উপস্থাপনায় বাংলাদেশের লড়াকু ও প্রতিষ্ঠিত নারীরা অংশ নেন। ছিলেন সাউথ এশিয়ান গেমসে সোনা বিজয়ী মাবিয়া আক্তার, এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদার, স্কলাস্টিকার এমডি মাদিহা মোর্শেদ, প্রথম কম্বেট পাইলট নাইমা হক ও তামান্না ই লুৎফি। আলোচনায় বক্তারা নিজেদের অনুপ্রেরণার গল্প শোনান। পরে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
প্রথিতযশা শিক্ষক ও নাট্য নির্দেশক জামিল আহমেদ, অনন্যা কবির ও সুপ্রভা বসেছিলেন ‘ইনট্যাঞ্জিবল’ নিয়ে আলোচনা করতে। আলোচকরা ঐতিহ্যবাহী অনেক পণ্য নিয়ে আলোচনা করেন। জামদানি, বাউল গান বা মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো ঐতিহ্যই ছিল তাদের আলোচনার অন্যতম অনুসঙ্গ।
বিকেলে লনের মঞ্চে কবিতা পড়েন সিরিয়ার কবি আদোনিস। তিনি আরবিতে কবিতা পড়েন লিট ফেস্টের পরিচালক কবি সাদাফ সায্ সিদ্দিকীর সঞ্চালনায়। সে সময় লনে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। জেরুজালেম নিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থ আল কুদস থেকে দুটি কবিতা পড়েন। তার মধ্যে একটি কবিতার নাম ছিল ভ্যানিস সাইন।
রিফাত মুনিমের উপস্থাপনায় ‘টেম্পোরারি পিপল’ শীর্ষক আলোচনায় দীপক উন্নি কৃষ্ণান এবং আন্দ্রে নাফিস সাহেলি। এখানে আলোচকদের দুজনই অভিবাসন ও পরবাস জীবন নিয়ে আলোচনা করেন। বক্তাদের কথায় অস্তিত্বহীনতার বেদনা উঠে আসে বারবার।
বিকেলে ভাস্কর নভেরায় ছিল কথা সাহিত্যিক পারভেজ হোসেনের সঞ্চালনায় বিশেষ সেশন রূপকথা ও পুরানো কথা যখন নতুন করে ফিরে আসে শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন আনিসুল হক, মইনুল আহসান সাবের, ফরিদা হোসেন এবং জহরসেন মজুমদার। বক্তাদের আলোচনার মূল উপজীব্য ছিল আমাদের সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ রূপকথা নিয়ে। যখন লেখকের পক্ষে সরাসরি বাস্তব ঘটনার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব হয়না তখন রূপকথাই আশ্রয় হয়ে ওঠে।
বুকার জয়ী নাইজেরিয়ান সাহিত্যিক বেন ওক্রির বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ফ্যামিশড রোড নিয়ে একটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে লেখক নিজে তার উপন্যাস থেকে পড়ে শোনান ও পাঠকদের প্রশ্নের জবাব দেন।
এবারের লিট ফেস্টে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে রোহিঙ্গা সংকট। দ্বিতীয় দিনেও ছিল রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সেশন। যেখানে জাফর সোবহানের সঞ্চালনায় লেখক, উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিক অংশ নেন। বক্তাদের আলোচনায় বারবার উঠে আসে শুধু বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমারে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদেরও সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। এই আলোচনায় সরাসরি কুতুপালং থেকে এসে অংশ নেন বৃটিশ সাংবাদিক জাস্টিন রোলেট।
শিশুদের জন্য ছিল আজ সর্বাধিক আয়োজন। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক শোনান সাত ভাই চম্পার গল্প। এর আগে সকালে কসমিক টেন্টে শুরু হয় নাজিয়া জাবিনের গল্প বলা। নাজিয়া তার বই থেকে বেশ কয়েকটি গল্প পড়ে শোনান শিশুদের। মাঝখানে নজরুল মঞ্চে লাঠিয়াল বাহিনীর কসরতেও মজা পায় শিশুরা। এরপর বটতলার পরিবেশনায় প্রদর্শিত হয় সুকুমার রয়ের নাটক। দুপুর ৩টায় ভারতীয় শিশুতোষ লেখক নন্দনা সেন তার বই মাম্বি অ্যন্ড নট ইয়েট থেকে গল্প পড়ে শোনান শিশুদের।
আগামী কালের আকর্ষণ ডিএসসি পুরস্কার
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ডিএসসি ‘প্রাইজ ফর সাউথ এশিয়ান লিটারেচার’। লিট ফেস্টের শেষ দিন ঘোষণা করা হবে এই পুরস্কার। মূলত দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে যেকোনও ধরনের লেখা এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। এ পুরস্কার শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার লেখকদের বিশ্বে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয় না বরং দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। ২০১০ সালে ডিএসসি সাহিত্য পুরস্কার প্রচলন করেছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সারিনা নারুলা। ডিএসসি পুরস্কারের সাথে ২৫ হাজার ডলারের একটি সম্মাননাও দেওয়া হয়। ছয় বছরের বেশি সময় ধরে ডিএসসি পুরস্কার আন্তর্জাতিকভাবে ব্যপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এ বছর ১৮ নভেম্বর ঢাকা লিট ফেস্টের শেষ দিনে ডিএসসি পুরস্কার ২০১৭ ঘোষণা করা হবে। ইতিমধ্যেই ৫ জন লেখককে সেরা এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। তারা হলেন, অঞ্জলি জোসেফ, অনুক অরুদপ্রগাসম, আরবিন্দ আডিগা, করণ মহাজন, স্টিফেন অল্টার। এ বছর বিচারক জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন রিতু মেনন, ভ্যালেন্টাইন কুনিংহাম, স্টিভেন বারনেস্টাইন, ইয়াসমিন আলীভাই এবং সিনেথ ওয়াল্টার পারেরা।