যে কারণে বাড়ছে শিশু ধর্ষণ ও হত্যা

শিশু নির্যাতনএ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাবা-মায়ের হাতে খুন হয়েছে ৩৮টি শিশু।এসব হত্যার পেছনে রয়েছে পারিবারিক কলহ, বাবা-মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক ও মাদকাসক্তির মতো বিষয়গুলো। কেবল শিশু হত্যাই নয়, একইসঙ্গে সারাদেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে শিশু ধর্ষণও। এ বছরের প্রথম ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ২৯৫। ইন্টারনেটে অবাধে পর্নোগ্রাফি পাওয়ার সুযোগ, মানসিক বিকারগ্রস্ততাসহ বিভিন্ন কারণে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সমাজ ও মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২৪১টি শিশু খুন হয়েছে। এর মধ্যে পিতা-মাতার হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ৩৮টি শিশু। আর ২০১৬ সালে খুন হয়েছে মোট ১৭৩টি শিশু। একইভাবে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা। এ বছর ২৯৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১৫৮টি ও ২০১৫ সালে ১৪১টি।
শিশু ধর্ষণ ও হত্যার পেছনে পারিবারিক কলহ, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও অনৈতিক সম্পর্ককে কারণ হিসেবে দেখছেন সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সমাজ ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকগুলো এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। এ কারণে কখনও কখনও শিশু হত্যাকে বাবা-মা প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। অনেক সময় আর্থিক কারণে, অথবা সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার ভাবনা থেকেও অনেক সময় বাবা-মা আত্মাহত্যা করেন,এ ক্ষেত্রে তারা আগে সন্তানদের হত্যা করেন। তারা মনে করেন, এতে সন্তানও কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। এই প্রবণতা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক।
এছাড়া, শিশু ধর্ষণের পেছনে মানুষের মূল্যবোধ-নৈতিকতার অবক্ষয়, পর্নোগ্রাফি, মাদকের প্রভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সহজে সবাই পর্নোগ্রাফি দেখতে পাচ্ছেন। এর ফলে  জৈবিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকে অনেকে শিশুদের ধর্ষণ করছে। আবার অনেক সময় অপরাধের বিচারে দীর্ঘসূত্রিতাও এ ধরনের  ঘটনায় সাহস জোগাচ্ছে।

সারাদেশে গত দুই মাসে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে দু’টি শিশু খুন হয়েছে বাবা ও মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের কারণে এবং আরেকটি হয়েছে পারিবারিক কলহের কারণে।

গত ২ নভেম্বর বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকার ময়নারটেকের একটি বাসায় বাবা জামিল শেখ  ও মেয়ে নুসরাতকে (৯) খুন করেছে মা আরজিনা বেগমের কথিত প্রেমিক শাহীন মল্লিক। ১ নভেম্বর রাজধানীর কাকরাইলে পারিবারিক কলহের কারণে খুন করা হয়েছে মা শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওনকে।

গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর পশ্চিম মাতুয়াইল কাজীরগাঁও এলাকায় মাদকাসক্ত বাবা তার চার বছর বয়সী সন্তান শাহীনকে খুন করে। ১৭ অক্টোবর রিকশাচালক সাজু (৩৫) এক শিশুকে ধর্ষণ করে। গত ১০ নভেম্বর রাজধানীর ভাষানটেক এলাকায় ১১ বছর বয়সী একটি শিশুকে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ষাটোর্ধ্ব রহমান দেওয়ানের বিরুদ্ধে। মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কয়েকমাস ধরে ওই শিশুকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

শিশু হত্যা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘শিশুরা যখন বাবা-মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাদের হত্যা করা হয়। এর বাইরে পারিবারিক কলহ, অর্থনেতিক দুরাবস্থাও এ ধরনের অপরাধের বড় কারণ।’

শিশু ধর্ষণ প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, ‘শিশুরা সবার কাছে খুবই আবেগপ্রবণ বিষয়। ধর্ষণ হচ্ছে বিকৃত মানসিকতার লক্ষণ। শিশুদের সামান্য কিছুতেই ভোলানো যায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিকৃত মানুষদের কেউ কেউ ধর্ষণের সুযোগ নিচ্ছে। মানুষের জৈবিক চাহিদা থাকবেই। আমাদের এখানে এখন পতিতালয় নেই, যা আগে ছিল। অতি প্রগতিশীল বা অতি সমাজসেবীরা এগুলো উচ্ছেদ করেছেন ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে। পৃথিবীর সব জায়গায় পতিতালয় আছে। এমনকি সৌদি আরবেও অফিসিয়াল না থাকলেও আন-অফিসিয়ালি পতিতালয় আছে। আমাদের এখানে মানুষ জৈবিক চাহিদা মেটাতে পারে না বলে শিশুদের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করে। এটা অনভিপ্রেত এবং খুবই দুঃখজনক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে শিশুরা নিজ বাবা-মায়ের হাতে খুন হচ্ছে। মাদকাসক্তি, অনৈতিক সম্পর্ক ও পারিবারিক কলহ এর  অন্যতম কারণ। এছাড়া, বাবা-মা প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবেও শিশু হত্যাকে বেছে নিচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সব বয়সী মানুষ সহজে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে সমাজে মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। এই বিকারগ্রস্ত লোকদের জৈবিক চাহিদার শিকার হচ্ছে শিশুরা। এছাড়া, অনেক সময় বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও সমাজে  ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়ছে।’

ড. মাহফুজা খানম আরও বলেন, ‘ছোট শিশুরা ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পারে না। একটু বড় হলে তারা ঘটনা-পরবর্তী বিষণ্নতায় আত্মহত্যা করতে পারে। তাদের বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগার প্রকোপও বেশি।’

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছি না। এ সুযোগটিই অপরাধীরা নিয়ে থাকে। অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমবে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এবং পরিবারকে আরও সোচ্চার হতে হবে।’

আরও পড়ুন: 

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হচ্ছে: তথ্যমন্ত্রী