আমার বিব্রতকর অবস্থার সমাপ্তি হলো: অ্যাটর্নি জেনারেল

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম (ফাইল ছবি)বিচারিক আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার গেজেট (প্রজ্ঞাপন জারি) হওয়ায় নিজেকে ভারমুক্ত মনে করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) সকাল ১১টার দিকে নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন, ‘শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মাঝখানে অবস্থান নিতে হয় আমাকেই। যাকে বলে সেতুবন্ধন ঘটানো। সুপ্রিম কোর্টের আগ্রহ ছিল, বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি হচ্ছে না কেন। তাছাড়া আমাকে বারবার সময় নিতে হয়েছে। এটা আমার জন্য নিশ্চয়ই বিব্রতকর ছিল। আমার সেই বিব্রতকর অবস্থার সমাপ্তি হলো।’
সোমবার (১১ ডিসেম্বর) জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, শৃঙ্খলাবিধির প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে। সেটি এখন বিজি প্রেসে ছাপা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গ ধরে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সামনে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তার ভাষ্য, ‘বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করেছেন রাষ্ট্রপতি। এর গেজেট প্রকাশিত হয়েছে গতকাল। এই বিধিমালা প্রণয়নের বিষয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, বিচার বিভাগীয় কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ও বিচার বিভাগীয় দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ অন্যান্য শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রদত্ত হবে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘এই গাইডলাইন অনুযায়ী সংবিধানের ১১৬ (অনুচ্ছেদ) জুডিশিয়াল সার্ভিস রুল বিধিমালা প্রণয়ন হয়েছে। এতে বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে— বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও অনুসন্ধান, অনুসন্ধানের পরে তাদের সাময়িক বরখাস্ত এবং অপরাধের তদন্ত কিভাবে হবে। রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন স্তরে পদক্ষেপের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন, একথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট যদি মনে করে স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনও অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার, তাহলে তারা রাষ্ট্রপতিকে জানাতে পারবেন ও এই পরামর্শের ধারাবাহিকতায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।’

নিম্ন আদালতের বিচারকদের অভিযোগগুলোর তদন্ত ও তার ফয়সালা কিভাবে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এর ফয়সালা হবে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন বা তিনি যদি অসদাচরণের খবর পান, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এছাড়া দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেবেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, বিভিন্ন পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের বিষয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে। এই বিধিমালায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মন্তব্য তার। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে পদক্ষেপই নেন না কেন, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই তা হবে। এখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে— কোনও অভিযোগ উত্থাপিত ও কারও বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার হলে অনুসন্ধান বা বিচার বিভাগীয় তদন্তের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন রাষ্ট্রপতি। কাউকে সাময়িক বরখাস্ত করা দরকার হলে সুপ্রিম কোর্টও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করবেন।’

মাহবুবে আলম মনে করেন, নিম্ন আদালতের বিচারক বা বিচার সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিতদের শৃঙ্খলা ও তাদের প্রশাসনিক পদক্ষেপের ব্যাপারে এখন আর কোনও বাধা রইলো না।

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কারণেই গেজেট প্রকাশে দেরি হয়েছে কিনা, সাংবাদিকরা জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন— ‘এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন। কাজেই আমি আর কিছু পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তিনি নিজেই জানিয়েছেন কেন এটি এতদিন হয়নি।’

এসকে সিনহার অবস্থানকে সংবিধানবিরোধী বলছেন কিনা জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য হলো— ‘না। সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ আছে, তাই সর্বময় ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে দিয়ে দেওয়া যায় না।’

সাবেক প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তা এই শৃঙ্খলাবিধির কারণে হতো না, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘এটা কোনও উচ্চতা না। সংবিধান সবার ওপরে। সংবিধান অনুযায়ী সবকিছু হতে হবে। একজন ব্যক্তির ইচ্ছাই বড় নয়। ব্যক্তি থাকে না, মারা যায়। কিন্তু সংবিধান থাকবে। কোনও ব্যক্তি যদি সংবিধানের চেয়ে বেশি বোঝেন মনে করেন, তাহলে কিন্তু ভুল।’

আগের ও এখনকার গেজেটের মধ্যে মূল তফাতটা কী ছিল জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যতদূর বুঝতে পেরেছি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চেয়েছিলেন, সব ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্ট তথা বিচার বিভাগের হাতেই থাকবে। এটা তো সংবিধানবিরোধী একটা অবস্থান। এটা হতে পারে না, ১১৬ অনুচ্ছেদ যে পর্যন্ত সংবিধানে থাকবে। সংবিধানে আছে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন।’

প্রধান বিচারপতি নিয়োগসহ অন্য সবকিছু নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন রাষ্ট্রপতি। অ্যাটর্নি জেনারেলের ভাষ্য, ‘একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি কোনও অভিযোগ আসে এবং তার যদি বিচার করার প্রয়োজন হয় আর তা যদি রাষ্ট্রপতি নিজে নিজেই করে ফেলতেন তাহলে বলা যেত সেখানে বিচার বিভাগকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। তা তো করা হচ্ছে না। যাই করা হোক না কেন সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে হবে।’

মাহবুবে আলম বললেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। রাষ্ট্রপতিই সংসদ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সবটারই সেতুবন্ধন একজন। রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ থাকে কিন্তু রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। এগুলোকে বাদ দেওয়া যাবে না।’

দেশে দ্বৈত শাসন বিরাজমান কিনা জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘না, দ্বৈত শাসন কেন বলবো? দ্বৈত শাসন যারা বলছেন তারা ঠিক বলছেন না।’

গেজেটে কোনও অসঙ্গতি থাকলে সে বিষয়ে কী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অসঙ্গতি থাকার কোনও প্রশ্নই আসে না। কারণ সু্প্রিম কোর্টের সঙ্গে আইনমন্ত্রী বসেছেন। যতটুকু জানি তাদের দেখিয়েই এগুলো করা হয়েছে।’