সোমবার (১ জানুয়ারি) ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসবের’ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হবে। এর আগেই বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা পাঠ্যবইগুলো পর্যালোচনা করে এমনটিই জানা গেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালের প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে বিতর্কিত ছাগল ও ওড়নাসহ ৯টি জায়গায় ছবিসহ পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ শীর্ষক বইটি থেকে ‘ও’ তে ‘ওড়না চাই’ সরিয়ে ওজনের চিত্র দেওয়া হয়েছে। আবার গাছে উঠে ছাগলের আম খাওয়ার চিত্র পরিবর্তন করে ছাগলকে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনের রিসার্চ টিম জানিয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে দ্বিতীয় পৃষ্ঠা এবং ১০ নম্বর পৃষ্ঠায় শুধুমাত্র দুটি ছবি পরিমার্জন করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার বিকৃত লাইনগুলো সংশোধন করা হয়েছে। সঙ্গে নতুন করে আরও চারটি লাইনযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া কিছু যোতি চিহ্নের পরিবর্তন করা হয়েছে। বইটির ‘ছবি ও কথা’ অধ্যায়ে ‘আমাদের বন্ধুরা’ গল্পে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। কবি আবুল হোসেনের ‘ঘুড়ি’ কতিবায় ‘ভারি যে কঠিন ঘুরির চাল’ এই লাইনটি দুইবার ব্যবহার করা হয়েছে। ‘স্টিমারের সিটি’ গল্পের তৃতীয় পৃষ্ঠায় ‘কাপড় ধুচ্ছে’ লাইনটি সংশোধন করে লেখা হয়েছে ‘কাপড় কাচছে’। চতুর্থ শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে কিছু ভুল বানান সংশোধন করা হয়েছে। এছাড়া সবই অপরিবর্তিত রয়েছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য মশিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কবিতাটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনাবলী’র তৃতীয় খণ্ডে যেভাবে আছে এটি সেভাবেই রাখা হয়েছে।’
২০১৭ সালের ষষ্ঠ শ্রেণির ‘চারু পাঠ’ থেকে এস. ওয়াজেদ আলীর ‘রাচি ভ্রমণ’ এবং সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’ বাদ দিলেও ২০১৮ সালের বইয়ে সেগুলোই রাখা হয়েছে। তবে বানান ভুল সংশোধন ছাড়া তেমন কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। সপ্তম শ্রেণির ‘সপ্তবর্না’ নামের বাংলা বইয়েও বানান ভুল সংশোধন ছাড়া আর কোনও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়নি। অষ্টম শ্রেণির ‘সাহিত্য কণিকা’ নামের বাংলা বইয়েও বানান ভুল সংশোধন ছাড়া তেমন কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। অন্যদিকে ২০১৭ সালের নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলা সাহিত্য’ বইটিতে অন্তত ১০টি গদ্য ও কবিতা রদবদল করা হয়েছে। যার সবগুলোই আগের মতোই রয়েছে ২০১৮ সালের পাঠ্যবইটিতে। তবে কিছু বানান সংশোধন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের রিসার্চ টিম।
জানা গেছে, হেফাজতের ২৯টি দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করা হলে শিক্ষাবিদদের ব্যাপক সমালোচনার পর শিক্ষামন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। একটি কমিটিকে সব শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ওই কমিটিকে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব বইয়ের ছোট ছোট বানান ভুল ও অসঙ্গতি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। হেফাজতের দাবিতে যুক্ত হওয়া ও বাদ পড়া গদ্য ও পদ্য আগের মতো ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাই বইগুলো কেবল বানান ভুল সংশোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতে প্রগতিশীল লেখক ও হিন্দু লেখকদের বাদ দেওয়া গল্প-কবিতা নতুন করে ২০১৮ সালের বইয়ে ফিরিয়ে না আনার সমালোচনা করেছেন শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এ এন রাশেদা। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বাদ দেওয়া গল্প-কবিতা ফিরিয়ে আনা হবে না কারণ যারা দাবি মেনে নিয়েছিল তাদের ও হেফজতের দর্শন একই। হেফাজত যদি আবার আন্দোলন শুরু করে সেই ভয়েও তারা আর পরিবর্তন করেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোটাই আমলা নির্ভর হয়ে পড়েছে। আমলারাই সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ। এ কারণেই তারা যখন যা মনে করছে তখন তাই করছে। দেশে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা নেই কিন্তু আমলাদের জামাই আদর করা হয়। চেয়ার নেই, টেবিল নেই, বসার জায়গা নেই, পদ নেই তবুও পদ বাড়িয়ে আমলা নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষকদের কত দুর্বিষহ অবস্থা। আর এমন হতে থাকলে তো শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হবে।’
পাঠ্যবইয়ের ভুল-ত্রুটি সংশোধন ও পরিমার্জন বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ের যেখানে ভুল ত্রুটি ছিল তার সবই সংশোধন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া সমালোচিত হওয়া জায়গাগুলোতেই সংশোধন আনা হয়েছে। আবার নবম-দশম শ্রেণির ১২টি বই সুখপাঠ্য করার জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে দিয়েছিল। সেই কমিটি যেভাবে কাজ করেছেন পাঠ্যবইগুলো সেভাবেই ছাপানো হয়েছে। এছাড়া এবার প্রাথমিক থেকে শুরু করে নবম-দশম পর্যন্ত সব বই মোটা কভারের এবং লেমিনেটেড।’