শিশুদের জন্মগত বাঁকা পা এখন আর কোনও সমস্যা নয়। একটু সচেতন থাকলে সহজেই এই সমস্যা সমাধান করা যায় বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে শিশুর জন্মগত বাঁকা পা ঠিক করা সম্ভব।
রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরের বাসিন্দা সালমা আখতার সন্তান প্রসবের কয়েকদিন পর বুঝতে পারেন যে, তার সন্তান নিপার পা বাঁকা। পরে তিনি স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে সন্তানকে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক তাদের জানান, এটি ক্লাবফুট সমস্যা। প্রথম অবস্থাতেই পায়ের চিকিৎসা করালে এর সমাধান সম্ভব। এরপর বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা করিয়ে সন্তানের সুস্থ পা নিয়ে বাড়ি ফেরেন সালমা বেগম। এখন তার সন্তান নিপার পা পুরোপুরি সুস্থ।
গ্লোবাল ক্লাবফুট ইনিশিয়েটিভের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে চার হাজার ৩৭৩টি শিশু ক্লাবফুট (বাঁকা পা) নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। বিশ্বে এই সমস্যা নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর হার প্রতি হাজারে এক দশমিক দুই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বিনামূল্যে ২০১০ সাল থেকে শিশুদের জন্মগত বাঁকা পায়ের চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। এ পর্যন্ত এখান থেকে ৫৯৯টি শিশুর মোট ৯১৪টি জন্মগত বাঁকা পায়ের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
দ্য গ্লেনকো ফাউন্ডেশনের ওয়াক ফর লাইফ প্রকল্পের এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন অফিসার লিটন রোজারিও বলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ২১ হাজার ৪০ জন শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৩১ হাজার ৫২১টি বাঁকা পায়ের চিকিৎসা করা হয়েছে। কারণ, সব শিশুর দুই পায়ে ক্লাব ফুট হয় না। এই শিশুদের মধ্যে ২/১ জন ছাড়া প্রায় ১০০ শতাংশ শিশুই চিকিৎসার মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘প্রথমে ডাক্তাররা ছেলের পায়ে প্লাস্টার করে দিয়েছিল। এর চার সপ্তাহ পর একটা অপারেশন করে। সেটা এখানে হয়নি। অপারেশন করানোর জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যেতে হয়। তিন মাস পরপর ছেলেকে এখানকার ডাক্তারদের দেখিয়ে নিয়ে যাই।’ নুরুন্নাহার বলেন, ‘এখানে চিকিৎসা, ওষুধ সব ফ্রি। শুধু বাড়ি থেকে আসা-যাওয়ার বাস ভাড়া,এই যা খরচ ।’
ছেলের পা আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো জানিয়ে নুরুন্নাহার বলেন, ‘এখন ছেলেকে একটা জুতা দিয়েছে। এটা রাতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরিয়ে রাখতে হয়। ওর পা সম্পূর্ণ ঠিক হতে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন।’
নুরুন্নাহারের ছেলে সাইয়্যেদের চিকিৎসা প্রসঙ্গে ক্লাবফুট প্রকল্পের সিনিয়র ক্লিনিক ম্যানেজার সাকিনা সুলতানা বলেন, ‘এই ছেলেটির পা এখন অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। আমরা তাকে এখন ফুটবল খেলার জন্য বলছি। তাকে পায়ের ওপর ভর দিয়ে টয়লেটে বসার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। সঙ্গে বিশেষ জুতা পরছে সে। এভাবে এক্সারসাইজের মধ্যদিয়ে তার পা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে রবিবার ও সোমবার সকাল নয়টা থেকে দুপুর দু’টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালে আবহাওয়াজনিত কারণে ফলোআপ রোগীর সংখ্যা কম থাকে। সোমবার সকাল থেকে ১৬ জন রোগী দেখেছি। এরা সবাই ফলোআপের রোগী। ’
শুধুমাত্র ২৭টি জেলার হাসপাতালে কেন এই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ জানতে চাইলে লিটন রোজারিও বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, দেশের ৬৪টি জেলার শিশুদেরই এই হাসপাতালগুলোর আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।’
বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এটা আসলে শিশুদের জন্মগত সমস্যা। আগে এই সমস্যার তেমন কোনও চিকিৎসা ছিল না। মানুষও তেমন গুরুত্ব দিতো না। তবে এখন সময় বদলেছে। এখন এই সমস্যার উন্নত চিকিৎসা আছে। তাই জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে এবং সঠিক চিকিৎসা দিলে বাঁকা পা স্বাভাবিক করা যায়। এটি এখন অপারেশন করে এবং শুধু পোনিচেটি প্লাস্টার করেও সারিয়ে তোলা যায়। এ পর্যন্ত আমাদের কাছে আসা সব শিশুর বাঁকা পা আমরা সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।’
বিএসএমএমইউ’র অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্লাবফুট বিষয়ক কো-অর্ডিনেটর ডা. কৃষ্ণ প্রিয় দাশ বলেন, ‘অনেকেই ভাবেন বাবা-মায়ের কারণে বাঁকা পা নিয়ে শিশুর জন্ম হয়। কিন্তু এটা আসলে জন্মগতভাবেই হয়। তবে এর কারণ এখনও জানা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, মায়ের পেটে পানি কমে গেলে এই রোগ হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সমস্যা দেখা গেলে শিশুকে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে শিশুটি সঠিক চিকিৎসা পাবে এবং সেটা সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে।’