ফেসবুকে ভাষার নতুন রীতি

ফেসবুকে ভাষার নতুন রীতিসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলা লেখা শুরুর পর এসেছে নতুন মাত্রা। চালু হয়েছে যেমন ইচ্ছে তেমন লেখার নতুন ভাষা রীতি। যারা প্রমিত ভাষা রীতি চর্চার পক্ষে তারা কখনই এটাকে ভালো চোখে দেখেননি। তবে গবেষকরা বলছেন, প্রমিত ভাষা ঠিক রেখে ফেসবুকে নতুন ভাষা রীতির নিরীক্ষা করলে মূল ভাষার ক্ষতি হবে না। আর অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মন্তব্য— ‘ব্লগ শুরুর পর থেকেই শব্দকে নিজেদের মতো করে ব্যবহারের প্রবণতা চলছে। সুনির্দিষ্ট পরিসরে এসব লেখা থাকে বলে এতে ভাষার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।’

নতুন এই ভাষা রীতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ফেসবুকে অনেকে প্রশ্ন করে শেষে ‘ফ্রান্স’ শব্দটি লেখেন। যারা এটি বোঝেন না তাদের মনে চট করে প্রশ্ন জাগতে পারে—দেশের নাম কেন এলো? আবার অনেকে সহজেই বুঝে নেন ‘ফ্রেন্ডস’ বা ‘বন্ধুরা’ বোঝানো হয়েছে ওই শব্দের মাধ্যমে।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই ‘আমার কী হবে?’ বোঝানোর জন্য লেখেন ‘আমার কী হপে?’ একইভাবে ‘প্রবলেম’কে ‘প্রব্লেন’, ‘কোথায়’কে ‘কুথায়’, ‘শুরু থেকেই’-এর পরিবর্তে ‘শুরুত্তে’, ‘মোহাম্মদপুর’কে ‘মোম্মতপুর’, ‘মন চায়’ কে 'মুঞ্চায়' লেখেন। কাউকে ‘তাড়াতাড়ি করো’ বোঝাতে ব্যবহার হয় 'ASAP' (As soon as possible)। অট্টহাসি বোঝাতে 'LOL' (Laughing Out Loud)  বা বাংলায় লেখা হচ্ছে 'লুল'। ফেসবুকে ভাষার নতুন রীতি

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘প্রতিনিয়ত ফেসবুক ব্যবহারের ফলে আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতিতেও এসেছে পরিবর্তন। প্রচলিত বেশ কিছু শব্দ এখন নতুনভাবে আসছে ফেসবুকের মাধ্যমে।’

ফেসবুকে ভাষার এমন ব্যবহারে বাংলা ভাষার কোনও সমস্যা হতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাষা এমনিতেই একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর নিত্য বিবর্তন হতেই থাকে। তবে ফেসবুকে যে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে কিছু শব্দ আমরা দেখি, এগুলো নিতান্তই মজা করে লেখা হয়। এগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। বাংলা ব্লগের শুরু থেকেই অনলাইনে অনেক নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে, সেগুলো কিছুদিনের জন্য জনপ্রিয়ও হয়েছে, তারপর আর টেকেনি।’

এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের মন্তব্য— ‘ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সমাজে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যেরকম ক্যাজুয়াল ভাষা ব্যবহৃত হয়, ফেসবুকেও সেই চর্চা হচ্ছে। এখানে তৈরি হওয়া শব্দ বা ভাষাভঙ্গি আমাদের ভাষার মূল গতিপথের ওপর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না।’ফেসবুকে ভাষার নতুন রীতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষার নতুন রীতি মূল বাংলা ভাষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। তবে প্রমিত ভাষা বলতে পারার পরই ভাষা নিয়ে নিরীক্ষা করা উচিত বলে তার অভিমত। তিনি বলেন, ‘ভাষার অনেক রূপ আছে। কথ্য, আঞ্চলিক, চৌরাস্তার ও  গালিগালাজের ভাষা। কিন্তু একটাই থাকে প্রমিত ভাষা। যা সব জাতি সংরক্ষণ করে। তরুণদের অনেকে কিন্তু এই ভাষাকে বিসর্জন দিচ্ছে।’

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘মিডিয়ার ভাষার কারণে হারিয়ে গেছে আঞ্চলিক ভাষা। আমাদের ভাষার যে ভাণ্ডার ছিল, তা হারিয়ে যাওয়া গৌরবের নয়। যে ভাষা আমরা ব্যবহার করছি তা ঔপনিবেশিক ভাষা। ভাষায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতেই করপোরেট পৃথিবী তরুণদের ওপর নতুন এই ভাষা চাপিয়ে দিচ্ছে। কারণ, ভাষায় বিশৃঙ্খলা থাকলে নতুন করে কিছু তৈরি হবে না।’

ঢাবি’র এই অধ্যাপকের ভাষ্য—‘এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানিরাও। শহীদেরা যদি জানতেন ভাষার এই পরিণতি হবে, তাহলে কি তারা প্রাণ বিসর্জন দিতেন? ফেসবুকে ভাষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করুক আপত্তি নেই। তবে এটি প্রধান ভাষা হলে সমস্যা। অনেকে বাংলায় একটা শুদ্ধ বাক্য উচ্চারণ করতে পারে না, ইংরেজি ছাড়া একটি বাক্য পূরণ করতে পারে না, এটা তো ঠিক না। তবে প্রমিত ভাষাটা শিখে যদি কেউ ফেসবুকে নতুন ভাষার এক্সপেরিমেন্ট করে, তাতে আমার আপত্তি নেই।’ফেসবুকে ভাষার নতুন রীতি

অন্যদিকে ঢাবি’র গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘ফেসবুকে ভাষার এই নতুন রীতির ব্যবহার সুনির্দিষ্ট। এর শুরু হয়েছিল ব্লগ থেকে। নতুন একটা ভাষা তৈরি হওয়া ক্ষতিকর কিছু না। এটা একটা অভিব্যক্তি। মজা করার জন্য কিংবা ফেসবুকিং আনন্দদায়ক করতে অনেক সময় এমন করা হয়। তবে এটা প্রমিত ভাষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কেননা, অফিসের কাজে কেউ এ ভাষা ব্যবহার করে না। ভাষার এই পরিবর্তনে আমি ক্ষতিকর কিছু দেখি না।’

ভাষার এ ধরনের ব্যবহারে কথ্য ভাষা বদলে যাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের মন্তব্য, ‘সেটা তো পাল্টে যাওয়ারই জিনিস, স্থির কিছু নেই এতে। এটা আটকানোর কোনও কর্তৃপক্ষ নেই। আইন করেও কিন্তু তা করা সম্ভব না।’