এবার দুই মাস আগেই বিনামূল্যের বই পৌঁছাবে উপজেলায়

বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই (ফাইল ছবি)বিশ্বব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ না থেকে নিজস্ব অর্থায়নে এবার প্রাথমিকের সব বই ছাপবে সরকার। নির্বাচনের বছরে ঝুঁকি এড়াতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নির্দিষ্ট সময়ের দুই মাস আগে অর্থাৎ, অক্টোবরের মধ্যেই ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের বই ছেপে উপজেলা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ারও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বই ছাপার প্রস্তুতি ও সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্বে থাকা ড. মিয়া ইনামুল হক রতন সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বার্ষিক সময়বদ্ধ কর্মপরিকল্পনা (এটিপিপি) অনুমোদন দিয়েছে। এরইমধ্যে আমরা শিক্ষক সহায়িকা ছাপানোর টেন্ডার আহ্বান করেছি। এ মাস বা মার্চের প্রথম সপ্তাহেই পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে। মার্চেই দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করে কার্যাদেশ দেওয়া হবে। নির্বাচনি বছর হওয়ায় ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সব বই ছাপার কাজ শেষ করে উপজেলায় পৌঁছে দেওয়া হবে।’

মুদ্রণশিল্প সমিতি সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। সমিতির চেয়ারম্যান তোফায়েল খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার চাইলে আমরা তিন মাস আগেও বই ছাপিয়ে সরবরাহ করতে পারবো। তবে দুটি সমস্যা রয়েছে। বই ছাপার বাজেটের অর্থ ছাড় করতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর লেগে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে এনসিটিবির কমিটমেন্ট ঠিক রাখতে হবে। ফান্ড অ্যারেঞ্জমেন্ট কনফার্ম করতে হবে। এনসিটিবির নিজস্ব কিছু ফান্ড আছে। এনসিটিবি কাজটি করে ১২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ পায়। তাদের কোনও সমস্যা থাকলে নিজস্ব ফান্ড থেকে আমাদের টাকা দিয়ে দেবে। যদি দেওয়া হয়, তাহলে সমস্যা থাকবে না। এছাড়া, আমাদের স্বার্থ বাদ দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করতে চায় এনসিটিবি। এটিও বিবেচনায় নিতে হবে। এবার বিল না দিয়ে বিদেশ চলে গেছেন চেয়ারম্যান। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সমস্যা তৈরি হবে।’

এ বিষয়ে ড. মিয়া ইনামুল হক রতন সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার মুদ্রণশিল্প মালিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া ঠিক থাকবে। বই ছাপতে সমস্যা হবে না।’
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার এটিপিপি অনুমোদন দিয়েছে গত ২৩ জানুয়ারি। আর গত ১১ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার এটিপিপি অনুমোদন দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকের বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে আগামী ৫ মার্চ। টেন্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ঠিকাদারদের সঙ্গে আগামী ৬ জুন চুক্তি হবে। সরকারি ক্রয়নীতি অনুযায়ী (পিপিআর) ঠিকাদারদের ৪৯ দিনের মধ্যে (৯ আগস্ট) অর্ধেক বই সরবরাহ করতে হবে। বাকি বই পরবর্তী ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হবে ১৫ জুন। ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহ করতে হবে।
মাধ্যমিক স্তরের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) কাগজ ও হার্ডবোর্ডসহ বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। বই ছাপার কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হবে ১ জুলাই। আর ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া, কাগজসহ মাধ্যমিক স্তরের (এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ও আলিম ভোকেশনাল) বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২৭ মার্চ। ঠিকাদারদের সঙ্গে বই ছাপার চুক্তি হবে ১১ জুলাই। আগামী ১৭ অক্টোবরের মধ্যে বই সরবরাহের সময় বেঁধে দেওয়া হবে।
কাগজ ছাড়া (এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ও আলিম ভোকেশনাল) বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২ মার্চ। ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হবে আগামী ১৫ জুন, ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহ করতে হবে। 
ব্রেইল, প্রাক-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হবে ২০ এপ্রিল। ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হবে ৮ আগস্ট, ২৮ নভেম্বরের মধ্যে বই ছাপিয়ে জেলা ও উপজেলায় পৌঁছে দিতে হবে।



তবে বই সরবরাহের এই সময় আরও এগিয়ে আনার চিন্তা-ভাবনা করছে এনসিটিবি। এর কারণ হিসেবে সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনি বছরের শেষ দিকে আন্দোলন করতে পারে বিএনপি। ওই সময় দেশে অস্থিরতাও তৈরি হতে পারে। বই ছাপিয়ে জেলা ও উপজেলায় পৌঁছাতে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতে পারে। কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া সরকারের বড় সাফল্য। এর ব্যত্যয় হলে সরকারের সাফল্য ম্লান হতে পারে। এ আশঙ্কা থেকেই দুই মাস আগে বই উপজেলা পর্যায়ের সরকারি গুদামে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের চাহিদা চেয়ে মাউশিকে (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর) চিঠি দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবারের (১৫ ফেব্রুয়ারি) মধ্যে চাহিদা পাঠাতে বলা হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ব্রেইল বইয়ের চাহিদা চেয়ে সমাজসেবা অধিদফতরকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হবে। প্রাথমিক স্তরের বইয়ের চাহিদা ৩০ জানুয়ারির মধ্যে দিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক ১০ শতাংশ টাকা দিয়ে শতভাগ খবরদারি করে। তারা বিগত সময়ে নানা জটিলতা তৈরি করেছে। নির্ধারিত সময়ে প্রাথমিকের বই সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হতো। তাই এবার নিজস্ব অর্থায়নেই বই ছাপানো হবে।’
প্রাথমিকের বই ছাপার জন্য প্রতিবছর বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নেওয়া হতো। এতে আন্তর্জাতিক দরপত্র এবং বিশ্বব্যাংকের নানা শর্ত প্রতিপালন ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার কারণে প্রাথমিকের বই ছাপা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হতো।