বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন ‘গায়েব’

বাকৃবিঅভিযুক্তদের বাঁচাতেই ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তদন্ত প্রতিবেদন গায়েব করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেদন গায়েব করে মূল অভিযুক্তের সহযোগীদের একজনকে প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. সাইফুল ইসলাম দাবি করেছেন তদন্ত প্রতিবেদন তাদের কাছে দেওয়া হয়নি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিযুক্তদের একজন (সাবেক রেজিস্ট্রার) অবসরে গেছেন।’

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে তদন্ত কমিটি। এই কমিটির প্রধান কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক পরেশচন্দ্র মোদক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে উপাচার্যকে তার দফতরে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।’

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘ভিসি স্যারকে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় বর্তমান রেজিস্ট্রার শুধু উপস্থিতি ছিলেন তা-ই নয়, কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমি তদন্ত প্রতিবেদন ভিসিকে পড়ে শুনিয়েছি তার উপস্থিতিতে।’

অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ও অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, অভিযুক্তদের প্রমোট করতে এবং বাঁচাতে প্রতিবেদন গায়েব করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে উপাচার্যের আদেশ না মানা, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ের অভিযোগে ২০১৫ সালের ৮ জুলাই তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় সাবেক ডিন ও কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক পরেশচন্দ্র মোদককে। কমিটির সদস্য সচিব করা হয় কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেনকে। এছাড়া সদস্য করা হয় পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসেমকে।

এই কমিটি অভিযোগের তদন্ত করে ওই বছরের ৫ অক্টোবর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবরের হাতে তার অফিসে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. সাইফুল ইসলাম উপাচার্যের অফিস কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

তদন্ত কামিটির প্রতিবেদনে ওই সময়ের রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে আনা অনিয়ম-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল খালেককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পক্ষে কমিটি মত প্রকাশ করছে।

এছাড়া, রেজিস্ট্রারের পরামর্শদাতা ও সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছেন উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. ইউসুফ আলী মণ্ডল, ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আ. বারেক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. বজলুর রহমানকে অন্যত্র বদলির সুপারিশ করে কমিটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা বাঞ্ছনীয় বলেও মত প্রকাশ করে কমিটি। পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে কিনা, তা পর্যক্ষেণের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সাবেক উপাচার্য ড. মো. রফিকুল হককেও অভিযুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘তদন্ত কমিটি মনে করে রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেক একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপসহ এসব অন্যায়, অনিয়ম ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। কাজেই শৃঙ্খলা আনার স্বার্থে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল হক, রেজিস্ট্রার এবং উল্লিখিত গ্রুপসহ অন্যান্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইননানুগ ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব ও সুনাম ফিরিয়ে আনতে হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে স্বেচ্চাচারিতা ও দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুলতানা রাজিয়া হলের তৃতীয় শ্রেণির এক নারী কর্মচারীর সঙ্গে উপাচার্যের গোপন কথোপকথনের কয়েকটি অডিও ফাঁস নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এ অবস্থায় ওই বছরের ৩১ মার্চ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল হক। সাবেক এই ভিসি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবেই রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ দুই বছরেও এই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে উদাসীন বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রশাসন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গায়েব করলেও প্রতিবেদনের সুপারিশের একটি অংশ বাস্তবায়ন করেছে। অভিযুক্ত সাবেক রেজিস্ট্রারকে স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল বারেক এবং বজলুর রহমানকে অন্য শাখায় অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের বদলির সুপারিশ ছিল। কিন্তু একই সুপারিশ থাকা অভিযুক্ত অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী মণ্ডলকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।