প্রবাসীদেরও দাঁতের চিকিৎসায় ভরসা বাংলাদেশ

বিএসএমএমইউতে একটি শিশুর দাঁত পরীক্ষা করে দেখছেন একজন চিকিৎসক।

প্রবাসী বাংলাদেশি রোখসানা বেগম (৩০) স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন কাতারে। দুই মাসের জন্য দেশে এসেছেন। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দাঁতের চিকিৎসাও করিয়ে নিচ্ছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দাঁতের চিকিৎসা তো অন্য চিকিৎসার মতো না। মুখ খুলে বসে থাকতে হয়। চিকিৎসক কী বলছেন সেটা বুঝতে হয়। বিদেশি চিকিৎসকদের দাঁতের সমস্যা বোঝানো কঠিন, সেদিক থেকে দেশি চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নেওয়াই সুবিধা।’

কেবল রোখসানা বেগমই নন, এমন আরও অনেক প্রবাসীই রয়েছেন, যারা দাঁতের চিকিৎসার জন্য নির্ভর করেন বাংলাদেশের ওপরই। ভাষাগত সুবিধার কথা তো রোখসানা বেগমই বললেন। ডেন্টাল সার্জনরা বলছেন, দেশে দাঁতের চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা গেছে। আর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় দেশে এই চিকিৎসার খরচ অনেক কম বলেই প্রবাসীরা দেশে এলে দাঁতের চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। তাই বিভিন্ন রোগে উন্নত চিকিৎসা নিতে দেশের মানুষকে বিদেশে ছুটতে হলেও দাঁতের রোগে উন্নত চিকিৎসায় বাংলাদেশ মোটেই পিছিয়ে নেই।

হাসপাতালে আসা রোগীদের দাঁত পরীক্ষা

ডেন্টাল সার্জনদের কাছ থেকে জানা গেছে, সৌদি আরব, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশে বসবাসকারী প্রবাসীরাও বাংলাদেশে দাঁতের চিকিৎসা করিয়ে থাকেন।

তেমনই আরেকজন সুরাইয়া মাহজাবিন (২২)। পরিবারের সঙ্গে তিনি থাকেন ইতালিতে। খালার সঙ্গে এসেছেন দাঁতের চিকিৎসা করাতে। তিনি বলেন, ‘আসলে দেশের বাইরে খরচ অনেক বেশি। তাই আমি তো বটেই, মা-বাবাও দেশে এলে দাঁতের চিকিৎসা করাই।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই তো দেশে আসা হয়। তখন আমরা অন্তত একবার দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাই।’

ডেন্টাল সার্জনরা বলছেন, দেশে দাঁতের চিকিৎসার মানের সঙ্গে উন্নত দেশের চিকিৎসার মানের খুব বেশি পার্থক্য নেই। স্টেম সেল থেরাপি কিংবা ফিলিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ম্যাটেরিয়ালে হয়তো বাংলাদেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে, তবে বাকি ক্ষেত্রগুলোতে দেশের ডেন্টাল সার্জনরাই সব ধরনের সেবা দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

চেম্বারে একটি শিশুর দাঁত পরীক্ষা করছেন একজন চিকিৎসক

এ ছাড়া, বাংলাদেশে যেমন চাইলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার সুযোগ আছে তেমন সুযোগ বেশিরভাগ দেশেই নেই। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে যেতে হয় কয়েক ধাপ পেরিয়ে। তাছাড়া, দাঁত ও চোখের চিকিৎসা স্বাস্থ্যবীমার আওতায় না থাকায় এর খরচ অনেক বেশি হয়।

বিএসএমএমইউয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আলী আসগর মোড়ল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউভুক্ত দেশগুলোতে দাঁতের চিকিৎসা করে থাকেন কনসালট্যান্টরা। সাধারণ মানুষদের পক্ষে তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আবার দেশগুলোতে দাঁত ও চোখের চিকিৎসা স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নেই। ফলে দাঁতের চিকিৎসায় আমাদের দেশের চিত্রটি বিপরীত। ওই উন্নত দেশে যারা প্রবাসী হিসেবে রয়েছেন, তারা দেশেই এই চিকিৎসা নেন।’

ডা. মোড়ল বলেন, বিদেশে প্রথমে একজন রোগীকে জেনারেল প্র্যাকটিশনারের কাছে যেতে হয়। তিনি প্রয়োজন মনে করলে ওই রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠান। সিস্টেমের কারণেই ওই সব দেশে সহজে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায় না। অনেক টাকাও খরচ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে চাইলেই একজন বিশেষজ্ঞকে দেখানোর সুযোগ আছে। তাই প্রবাসীরা দেশে দাঁতের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।

একজন নারীর দাঁত পরীক্ষা করছেন একজন দন্ত চিকিৎসক

বিদেশে দাঁতের চিকিৎসার খরচে বিষয়ে বিএসএমএমইউয়ের এই কোষাধ্যক্ষ বলেন, ‘আমার একজন পেশেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গভর্নমেন্টে চাকরি করে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল প্রকৃত ঘটনা। তিনি জানালেন, এখানে তিনি যে চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেই একই চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রে খরচ হতো কয়েকগুণ। ওই খরচ তার এখানকার চিকিৎসাসহ আসা-যাওয়ার খরচের চেয়েও বেশি।’ ভারতের মুম্বাই থেকেও অনেক রোগী তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন বলেও জানালেন তিনি।

বিএসএমএমইউয়ের প্রিভেনটিভ অ্যান্ড চিলড্রেন ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের উইং প্রধান ও অধ্যাপক ডা. জেবুন নেছা বলেন, ‘দাঁতের চিকিৎসা বাংলাদেশে বেশ ভালো। খরচও তুলনামূলকভাবে কম। তাই যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা থেকেও অনেকে আমাদের বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে।’

ডা. জেবুন নেছা আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে একটু সিনিয়র চিকিৎসক যারা রয়েছেন, তারা দাঁতের চিকিৎসার আধুনিক সব প্রযুক্তিই ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু খরচটা অনেক কম এখানে। এখানে যে কাজটা এক হাজার টাকায় করা যায়, সেটা হয়তো বিদেশে করতে গেলে এক হাজার ডলার লাগবে। এটা কিন্তু অনেক টাকা। তাছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সেবার মান উন্নত হয়েছে। আমাদের কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তো বাইরের অনেক চিকিৎসকের চেয়েও ভালো সেবা দিয়ে থাকেন।’

একজন রোগীকে পরীক্ষা করছেন এক দন্ত চিকিৎসক

অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও নিটোল ডেন্টাল চেম্বারের ডেন্টাল সার্জন ডা. মো. আনোয়ারুল হক বলেন, ‘বিদেশে দাঁতের চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, একটু জটিল সমস্যা নিয়ে গেলে তার জন্য আয়ের সবটাই খরচ হয়ে যায়। এমনকি বিমান ভাড়া দিয়ে দেশে এসে চিকিৎসা করানোটাও প্রবাসীদের জন্য সাশ্রয়ী হয়ে দাঁড়ায়।’

বাংলাদেশে দাঁতের চিকিৎসার মান নিয়ে অধ্যাপক আলী আসগর মোড়ল বলেন, ‘আমাদের দেশের চিকিৎসার মান আন্তর্জাতিক মান থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। আমি নিজে অনেক দেশে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে গিয়েছি। দেখেছি, দুয়েকটি বিষয় ছাড়া আমরা তাদের থেকে পিছিয়ে নেই। অত্যাধুনিক স্টেমসেল থেরাপিতে হয়তো আমরা সামান্য পিছিয়ে আছি। আবার দাঁতের ফিলিংয়ে আমরা যে ম্যাটেরিয়ালটা ব্যবহার করি, সেটা হয়তো ওদের দেশে একটু উন্নত। সব মিলিয়ে আমরা হয়তো ১০ ভাগ পিছিয়ে রয়েছি। তাই দেশে এসে যারা দাঁতের চিকিৎসা করান, তাদের কোনও অভিযোগ থাকে না।’

তবে একটি বিষয়ে রোগীদের সতর্কও করেছেন ডা. মোড়ল। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি কোয়াকের মাধ্যমে চিকিৎসা নেন, তাহলে কিন্তু দেশে দাঁতের চিকিৎসা সম্পর্কে তার ধারণা বদলে যাবে। তাই চিকিৎসা নিতে হলে অবশ্যই ডেন্টাল সার্জনের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই।’