গুলশান হামলা মামলা: সাগর গ্রেফতার হওয়ায় পরিবর্তন আসছে চার্জশিটে

গুলশান হামলার বিস্ফোরক সরবরাহকারী সন্দেহে গ্রেফতার হাদিছুর রহমান সাগর

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় এ মাসেই আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়ার কথা ছিল তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি’র। সেই অনুযায়ী প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পন্নও করা হয়েছিল। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ঘটনার এই চার্জশিট। কিন্তু বুধবার (২১ মার্চ) রাতে এই হামলার ঘটনার অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী হাদিছুর রহমান সাগর গ্রেফতার হওয়ায় চার্জশিট জমা দেওয়ার সময় পিছিয়ে গেল।

ইতোমধ্যে সাগরকে গুলশান হামলার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে সাগরে কাছ থেকে পাওয়া তথ্য চার্জশিটে যোগ করা হবে। সিটিটিসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সিটিটিসি’র উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘সাগরকে আমরা বহুদিন ধরে খুঁজছিলাম। গুলশান হামলার নেপথ্যে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অন্য আসামিদের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী হিসেবে সাগরের নাম এসেছে। একারণে সাগরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

এ ব্যাপারে মহিবুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘সাগর যেহেতু গ্রেফতার হয়েছে তাই সাগরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত চার্জশিটে যোগ করা হবে। একইসঙ্গে সে যদি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়, সেটাও চার্জশিটে যোগ করা হবে। এজন্য চার্জশিট দিতে আরেকটু সময় লাগবে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, আলোচিত গুলশান হামলা মামলার মূল রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তারা। এই ঘটনার সঙ্গে এখন পর্যন্ত ২১ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছে। এছাড়া সিটিটিসি’র পৃথক অভিযানে ৭ জন ও র‌্যাবের অভিযানে মারা গেছে আরও একজন। এদের মধ্যে মূল পরিকল্পনাকারী হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ মারা যায় সে।

এছাড়া হামলার পরিকল্পনাসহ অন্যান্য ভূমিকায় যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তারা হলো- সরোয়ার জাহান মানিক, তানভীর কাদেরী, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম, নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান এবং আবু রায়হান তারেক। এদের মধ্যে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুর অভিযানে আবু রায়হান তারেক, ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগরের অভিযানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম, ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের অভিযানে তানভীর কাদেরী, ৮ অক্টোবর আশুলিয়ার অভিযানে সরোয়ার জাহান মানিক ওরফে আব্দুর রহমান, গত বছরের ৫ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে সিটিটিসি’র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নূরুল ইসলাম মারজান এবং ২৬ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের অভিযানে বাশারুজ্জামান চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান মারা যায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নিহতদের প্রত্যেকের ভূমিকা উল্লেখ করে চার্জশিট থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হবে। সাধারণত অভিযুক্ত ব্যক্তি নিহত হলে চার্জশিটে তাদের ভূমিকা উল্লেখ করে অভিযোগ থেকে অব্যাহিত দেওয়া হয়ে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় সর্বশেষ হাদীসুর রহমান সাগরসহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা হলো- রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাসনাত রেজা করিম, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ও মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। এদের মধ্যে রিগ্যানের বিরুদ্ধে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ, রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে পরিকল্পনা ও হামলাকারী সরবরাহ, রাশেদ ওরফে র‌্যাশের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা ও রেকি এবং সোহেল মাহফুজ ও বড় মিজানের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের অভিযোগ আনা হবে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সাগর বাদে গ্রেফতারকৃত পাঁচ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যোগসূত্র না পাওয়ায় হাসনাত করিমকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে।

সূত্র জানায়, তামিম ছিল এই হামলার মূল নেপথ্য নায়ক। মারজান ছিল তার সহযোগী ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। তানভীর কাদেরী হামলকারীদের আশ্রয়দাতা ও অর্থসরবরাহকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তামিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বাশারুজ্জামান চকলেট অর্থ ও অস্ত্রবহনকারীর দায়িত্ব পালন করে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম হামলকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়। সীমান্ত এলাকা থেকে রাজধানী পর্যন্ত অস্ত্র আনার দায়িত্ব ছিল ছোট মিজানের ওপর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হলি আর্টিজানে হামলার প্রাথমিক পর্যায়ে পরিকল্পনাকারী হিসেবে আরও দুই জনের নাম এসেছে। তারা হলো- মামুনুর রশিদ রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালিদ। তবে তারা দীর্ঘদিন আগেই পাশের একটি দেশে পালিয়ে যায়। তাদের পলাতক দেখিয়ে চার্জশিট দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হয়। রাতভর জিম্মিদশার অবসান হয় পরদিন সকালে। পুলিশ ও র‌্যাবের সহায়তায় জিম্মিদের উদ্ধারে অভিযান চালায় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর একটি দল। এতে পাঁচ জঙ্গি ও হলি আর্টিজানের এক পিৎজা শেফ নিহত হয়। এছাড়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও এক সহকারী কুক। এ ঘটনায় গুলশান থানা পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করে।