সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় মাত্র একটি বাস টার্মিনাল ছিল। এই টার্মিনালটিকে স্থানান্তর করার জন্য আনন্দবাজার, সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালীতে জমি দেওয়া হয়। তৎকালীন সিটি করপোরেশন সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালীতে বাস টার্মিনাল স্থানান্তর করলেও আনন্দবাজারে টার্মিনাল নির্মাণের কাজে হাত দেয়নি। সে সময় রেলওয়ে থেকে আনন্দবাজারে চার একরের কিছু বেশি জমি সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হলেও পরবর্তীতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেলওয়ে আবার তা ফিরিয়ে নেয়। কথা ছিল রেলওয়ে সেখানে একটি অত্যাধুনিক সুপার মার্কেট নির্মাণ করবে। কিন্তু তাও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ফুলবাড়িয়া থেকে পুরোপুরি টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
যানজট কমাতে ফুলবাড়িয়া থেকে টার্মিনাল স্থানান্তর করে সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালীতে নেওয়া হয়। তখন সেগুলো মূল শহরের কিছুটা বাইরে হলেও এখন শহর বেড়েছে। তাই এসব টার্মিনালের কারণে ঢাকার প্রবেশপথও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানী পরিণত হয়েছে যানজটের নগরীতে।
কর্মকর্তারা আরও বলছেন, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ ও ফুলবাড়িয়া এলাকায় রাখার জায়গা না থাকায় বাস রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। নগরীতে যানজটের একমাত্র কারণ এই যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও অব্যবস্থাপনা। বিষয়গুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে বর্তমানে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। কেননা, ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া হয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করছে। প্রায় লক্ষাধিক নাগরিক প্রতিদিন এ পথে যাতায়াতের সময় গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া এলাকার যানজটে দুর্ভোগে পড়েন। এছাড়া, কমলাপুর টিটিপাড়ার রেলওয়ের জায়গায় অবৈধ বস্তি রয়েছে। বস্তিটি উচ্ছেদ করে সেখানে একটি ট্রাক টার্মিনাল স্থাপন করা হলে সড়কে অবৈধ পার্কিং অনেকাংশে কমবে। এ দুটি বস্তি ছাড়াও আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড উচ্ছেদের পরিকল্পনা রয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের।
বস্তি দুটি উচ্ছেদের বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে, ডিএমপি, র্যাব ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করে দেন মেয়র। কমিটির আহ্বায়ক হলেন ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মালেক। অন্যান্য সংস্থাগুলোর একজন করে প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকবে। গত বছরের ১২ নভেম্বর নগরীর সেবা সংস্থাগুলোকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় মেয়র মো. সাঈদ খোকন ওই কমিটি গঠন করে দেন। কমিটিকে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদনটি দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কমিটি গঠনের ছয় মাস পার হলেও এখনও কোনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
ওই সভায় সংস্থার মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, ‘আনন্দবাজার বস্তি একটি মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত। এ বস্তিকে উচ্ছেদ করে সেখানে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডটি স্থানান্তর করা যায়। এতে সড়কে আর গাড়ি পার্কিং থাকবে না। ফলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় যানজট অনেকাংশে কমবে।
কমিটির অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড আনন্দবাজারে স্থানান্তর করার জন্য ‘ওয়ান স্টপ বাস সার্ভিস’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু জায়গাটি বর্তমানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিলে সেখানে পরবর্তী কার্যক্রম চালানো হয়। এছাড়া, কমিটির আর কোনও অগ্রগতি নেই। কমিটি জরিপ পরিচালনা করতে হলে আগে জমির মালিক দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে হতে হবে।’
এর আগে ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি দক্ষিণ নগর ভবনে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় মেয়র সাঈদ খোকন ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান ও রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের কাছে আনন্দবাজার বস্তিতে বাসস্ট্যান্ড স্থাপনের জন্য জমি চান। এ সময় মন্ত্রী প্রথমে রাজি না হলেও পরে মৌখিকভাবে জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরবর্তীতে তা দীর্ঘদিন ধরে থেমে থাকে। একপর্যায়ে জমি ব্যবহারে সম্মতি দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এরপর এই উদ্যোগ নেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
তবে বস্তি উচ্ছেদে সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তে আস্থা রাখতে পারছে না উচ্ছেদের পরিকল্পনায় থাকা ঢাকার এই দুই বস্তিবাসী। তারা বলছেন, ‘অতীতেও সিটি করপোরেশন বস্তিবাসীকে পুনর্বাসনের জন্য এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাতে প্রকৃত বস্তিবাসী কোনও লাভবান হয়নি।’
সরেজমিন আনন্দবাজার গিয়ে দেখা গেছে, রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন পুরো এলাকাটি বেদখলে রয়েছে। বস্তির ভেতরে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে কাঁচাবাজার। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার অংশে সড়কের পাশে রয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাও। রয়েছে কয়েকটি তিন-চারতলা ভবনও। তাছাড়া, আনন্দবাজার জামে মসজিদও গড়ে উঠেছে বস্তির বিশাল এলাকায়। পুরো এলাকাটি উচ্ছেদে কতটুকু সফল হওয়া যাবে তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে কথা হয় আনন্দবাজার বস্তির বাসিন্দা আরজুমান বেগমের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নদীভাঙনের কবলে পড়ে ভিটেমাটি সব হারিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে এই রেলওয়ের পরিত্যক্ত জমিতে টংঘর নির্মাণ করে বসবাস করছি। স্বামী রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করেন তা দিয়েই কোনোভাবে পাঁচ সদস্যের সংসার চলে। সরকার যদি চায় তাহলে আমাদের অন্যত্র পুনর্বাসন করে উচ্ছেদ করতে পারে। কিন্তু তাদের প্রতি তো আমাদের সেই আস্থা নেই। অতীতেও এমন অনেক প্রকল্পের কথা শুনেছি। কিন্তু তাতে বস্তিবাসীর কোনও উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না। ’
অন্যদিকে কমলাপুরের টিটিপাড়া রেলওয়ে বস্তিটিও রয়েছে ভাসমান মানুষের দখলে। এই বস্তিটিতে অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসবাস রয়েছে। এ বস্তির বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিষয়ক একটি দফতরও রয়েছে। কিন্তু বিগত সময়ে এই দফতর বস্তিবাসীর কোনও উপকারে এসেছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। যদি বস্তিবাসীর মতামত না নিয়ে বা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটি করপোরেশনের একজন সার্ভেয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সমন্বয় সভায় বস্তি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু জমির মালিকানা এখনও হস্তান্তর করা হয়নি। তাহলে কীভাবে অন্যের জমিতে সিটি করপোরেশন উচ্ছেদে যাবে? আগে জমির মালিকানা পরিবর্তন করতে হবে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।