পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান হত্যার পর লাশ গুমের চেষ্টার এমন চাঞ্চল্যকর বিবরণ দিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া এক ব্যক্তি। মঙ্গলবার রাতে প্রকৌশলী রহমত উল্লাহ (৩৫) নামের এই অভিযুক্ত আসামিকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার তাকে আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমানে তাকে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় বনানী থানায় নিহত মামুনের ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। ইতোমধ্যে রহমত উল্ল্যাহ নামে এক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ও সহযোগীদের নাম বলেছে। মামুন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শোবিজ মিডিয়ায় মাঝে মধ্যে অভিনয় করার সুবাদে রহমত উল্লাহ'র সঙ্গে পরিচয় ছিল মামুনের। রহমত উল্লাহ পেশায় প্রকৌশলী হলেও শোবিজ মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত। গত রবিবার বিকেলে রহমতের সঙ্গে ফোনে কথা হয় মামুনের। এ সময় রহমত তাকে মডেল ও অভিনেত্রী মেহেরুন নেছা আফরিন ওরফে আন্নাফি আফরিনের জন্মদিনের পার্টি আছে বলে জানায়। মোটরবাইক নিয়ে মামুন যায় বনানীর ২/৩ সড়কে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করা রহমত তাকে নিয়ে যায় ওই সড়কের ৫ নম্বর বাসার এ-২ ফ্ল্যাটে। ওই ফ্ল্যাটেই আন্নাফি আফরিনসহ স্বপন, মিজান, আতিক, শেখ হৃদয় ওরফে আপন ওরফে রবিউল, সুরাইয়া আক্তার কেয়া, ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে মাইশা অপেক্ষা করছিল। আগে থেকেই তারা একসঙ্গে ইয়াবা সেবন করেছিল। সেখানে মামুন ও রহমত যাওয়ার পর পূর্ব-পরিকল্পনা মতো অশ্লীল ছবি তুলে মামুনকে আটকে রেখে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে সংঘবদ্ধ এই চক্র। কিন্তু মামুন নিজেকে পুলিশ পরিচয় দেন। এ সময় আগে থেকেই ইয়াবা সেবন করা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা তাকে বেদম মারধর করে। এতে অচেতন হয়ে যান মামুন। পরে রাতভর লাশের সামনে বসেই লাশ গুমের পরিকল্পনা করে তারা।
রহমত উল্ল্যাহর ভাষ্য, বাঁশঝাড়ের ভেতরে লাশের বস্তাটি ফেলার পর সে তাতে নিজেই তেল ঢেলে দেয়। তার অন্য সহযোগীরা আগুন ধরিয়ে দিলে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। তারা সেখানে আর অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ঢাকায় আসার পর যার যার গন্তব্যে চলে যায়।
ফাঁদ পেতে নিয়মিত অর্থ আদায় করতো চক্রটি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কথিত মডেল ও অভিনেত্রীসহ ১০-১২ জনের এই সংঘবদ্ধ চক্রটি ফাঁদ পেতে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতো। নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি এই চক্রের মূলহোতা। চলতি বছরের মে মাসে বনানীর ২/৩ সড়কের ৫ নম্বর ভবনের এ-২ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় নজরুল। সেখানে বায়িং হাউস ও মায়ের আঁচল নামে একটি বৃদ্ধাশ্রমের প্রধান কার্যালয় ও শোবিজ মিডিয়ার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের কথা বলে। শেখ হৃদয় ওরফে আপন ওরফে রবিউলকে এই কার্যালয় চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। শেখ হৃদয় এই বাসায় নিয়মিত মদ-জুয়ার আসর বসাতো। এসব আসরে থাকতো কথিত অভিনেত্রী ও মডেল শেখ আন্নাফি ওরফে মেহেরুন নেছা ওরফে আফরিন, ফারিয়া বিনতে মিম ওরফে মাইশা ও সুরাইয়া আক্তার কেয়া। স্বপন, মিজান ও আতিক মিলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করে। তারা মদ-জুয়ার আসরের আড়ালে কৌশলে এসব অভিনেত্রী ও মডেলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতো। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত দেহ ব্যবসাও চলতো এই বাসায়।
মিরাজ জানান, ওই বাসায় শেখ হৃদয়ের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে এক নারীসহ আরও কয়েকজন নারী নিয়মিত যাতায়াত করতেন। মিডিয়ার কার্যালয় বলে তারা এসব বিষয়কে কিছু মনে করতেন না। সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল তাদের। কিন্তু এখানে একজনকে হত্যার পর সেই লাশ পুড়ে গুম করার চেষ্টা করা হতে পারে এমন বিষয় কল্পনাতেও ছিল না তাদের।
শাজাহানপুর কবরস্থানে মামুনের লাশ দাফন
লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার দুপুরে শাজাহানপুরে স্থানীয় কবরস্থানে মামুনের লাশ দাফন করা হয়েছে। মামুনের বাবার নাম মৃত আজহার আলী খান। গ্রামের বাড়ি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার রাজারামপুর এলাকায়। শাজাহানপুরের ১২৯ নম্বর মধ্য বাসাবোর বাসায় বড় ভাই জাহাঙ্গীর ও মায়ের সঙ্গে থাকতেন। ২০০৫ সালে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে পুলিশে যোগ দেন তিনি।
মামুন ঢাকার বিভিন্ন থানা ও গোয়েন্দা কার্যালয়ে চাকরি করেছেন। ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে ইন্সপেক্টর হয়ে চট্টগ্রামে বদলি হন। মাস চারেক আগে আবারও বদলি হয়ে তিনি ঢাকায় এসবিতে আসেন। পুলিশের চাকরির পাশাপাশি তিনি নিয়মিত নাটক- টেলিফিল্মে ওঅভিনয় করতেন। মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ভাইকে তো হারিয়েছি। এখন আমরা চাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।