এসবির কর্মকর্তা মামুন হত্যা

বন্ধু রহমতের কাছ থেকেও অর্থ হাতিয়ে নেয় প্রতারকচক্র

মামুন ইমরান খানস্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) কর্মকর্তা মামুন ইমরান খানকে হত্যার পর তার লাশ গাজীপুরে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে সংঘবদ্ধচক্রের সদস্যরা মামুনের বন্ধু রহমত উল্ল্যাহকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। টাকা না দিলে তাকেও হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয় প্রতারকরা। রহমত উল্ল্যাহ তখন ভয় পেয়ে যায়। সে সঙ্গে থাকা ডেবিট কার্ড দিয়ে কিছু টাকা ওই চক্রের সদস্যদের হাতে তুলে দেয়। যদিও রহমতের সহযোগিতা নিয়েই মামুনের লাশ গাজীপুরে গুম করার চেষ্টা করা হয়। রহমত নিজেই গাড়ি চালিয়ে লাশ নিয়ে গাজীপুরে নিয়ে যায়।

মামুন ইমরান হত্যা ঘটনায় বুধবার (১৮ জুলাই) রাতে বাড্ডা ও হাজারীবাগ এলাকা থেকে আরও চারজনকে গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার (১৯ জুলাই) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিবির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন। তিনি বলেন, ‘সংঘবদ্ধ ওই চক্রের মূল টার্গেট ছিল রহমত উল্ল্যাহ। ফাঁদ পেতে কথিত মডেল ও অভিনেত্রী আন্নাফি আফরিন রহমতকে বনানীর ২/৩ সড়কের পাঁচ নম্বর ভবনের বাসায় ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু রহমত সেখানে যাবার সময় ৪-৫ বছরের পুরনো বন্ধু মামুনকে সঙ্গে নিয়ে যায়।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, ‘ঘটনার দিন রহমত ও মামুন ওই বাসায় গেলে আফরিন নিজেই নিচে নেমে তাদের রিসিভ করে দোতালার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তারা ঢোকার পরপরই কয়েকজন যুবক নিজেদের ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয় দিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। এ সময় মামুন নিজের পরিচয় প্রকাশ করলে তাকে কিল-ঘুষি মেরে হত্যা করা হয়।’
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ওই বাসায় কথিত তিন নারী মডেল ও অভিনেত্রীকে দিয়ে প্রতারকচক্রটি মূলত দেহ ব্যবসা ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের কাজ করতো। একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক তিন সদস্য স্বপন, আতিক ও দিদার এই কাজে নেতৃত্ব দিতো। বাসার ম্যানেজার শেখ হৃদয় ওরফে আপন ওরফে রবিউল পুরো বিষয়টি তদারকি করতো। তাদের সহযোগিতা করতো মিজান শেখ। ওই বাসাটি নজরুল ইসলাম ওরফে নজরুল রাজ নামে কথিত এক অভিনেতা ভাড়া নিয়ে এসব কাজ করাতো বলে গ্রেফতার ব্যক্তিরা স্বীকার করেছে।

দড়ি দিয়ে হাত-পা বাঁধা, মুখে টেপ
নতুন করে চারজনকে গ্রেফতারের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মামুনের পুলিশ পরিচয় পাওয়ার পরপরই দড়ি দিয়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। একই সঙ্গে মুখে কস্টেপ পেঁচিয়ে কিল-ঘুষি মারা হয় তাকে। এতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মামুন ইমরান খান। মামুন মারা গেলে তার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রাখা রহমতকে মুক্ত করে দিয়ে লাশ কীভাবে গুম করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করে। রহমত নিজেও এই হত্যার অভিযোগ থেকে বাঁচতে সংঘবদ্ধ ওই চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লাশ গুমের পরিকল্পনা করে।
ডিবি হেফাজতে মামুনের হত্যাকারীরা
ডিবির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, ‘তারা লাশটি একবার পানিতে ফেলে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিল। আবার কোথাও নিয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখার পরিকল্পনা করে। পরে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যাতে মামুনের চেহারা কেউ চিনতে না পারে। এরপরই তারা বস্তায় ভরে লাশ নিয়ে গাজীপুরের দিকে যায়।

গাড়িতে লাশ রেখে ক্যান্টিনে খাবার খায় খুনিরা

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, মামুনের লাশ গাড়িতে নিয়ে দুর্বৃত্তরা সোজা গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা লাশটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় সুযোগ খোঁজে। একপর্যায়ে দুপুরের দিকে তারা গাড়িতে লাশ রেখেই ক্যান্টিনে খাবার খায়। পরে সেখানে আরও কিছু সময় কাটিয়ে গাজীপুরের কালিগঞ্জ থানার উলুখোলা এলাকার রাস্তায় নিয়ে একটি বাঁশঝাড়ে লাশটি পুড়িয়ে ফেলে তারা।
তদন্ত তদারক কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন বলেন, ‘সংঘবদ্ধ এই চক্রের তিন সদস্য স্বপন, দিদার ও আতিক সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। তাদের একজন রিটায়ার্ড, আর বাকি দুজন বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা। এ কারণে তারা লাশ গাড়িতে নিয়ে রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে, সেখানকার ক্যান্টিনে খাবার খায়। সেখান থেকে তারা কালিগঞ্জের দিকে চলে যায়।’
আব্দুল বাতেন বলেন, ‘এই ঘটনায় আমরা এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছি। এরমধ্যে প্রথমেই গ্রেফতার করা রহমত আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এখনও চারজন পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে অভিযান চালানো হচ্ছে।’ খুব শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই সবুজবাগ এলাকার বাসা থেকে বনানী গিয়ে নিখোঁজ হন পুলিশের বিশেষ শাখার ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান। পরদিন তার বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম ১০ জুলাই রহমত উল্ল্যাহ নামে মামুনের এক বন্ধুকে গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যমতে, ওই দিনই গাজীপুরের কালীগঞ্জের উলুখোলা রাইদিয়া এলাকার রাস্তার পাশে নির্জন একটি বাঁশঝাড় থেকে মামুনের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন বনানী থানায় নয়জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে মামুনের ভাই।