ঘরের মেঝেতে কে রেখেছে গুপ্তধন?

গুপ্তধনের খবরে উৎসুক মানুষের ভিড়মিরপুর মডেল থানায় দয়েরকৃত একটি সাধারণ ডায়েরিকে (জিডি) কেন্দ্র করে ‘গুপ্তধন’র খোঁজে নেমে পড়েছে প্রশাসন। ঘরের মেঝেতে কোথা থেকে কীভাবে আসলো এই গুপ্তধন? কোন বিশ্বাসে প্রশাসন এভাবে গুপ্তধন খুঁজছে? সত্যিই কি গুপ্তধন আছে? নাকি অন্য কিছু?

এরকম অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে মিরপুর-১০ নম্বরের ‘সি’ ব্লকের একটি বাড়িতে কথিত ‘গুপ্তধন’ থাকা নিয়ে। তবে আদৌ গুপ্তধন আছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনও তথ্য নেই কারও কাছেই। তবুও চলছে গুপ্তধন উদ্ধারের অভিযান।  

শনিবার (২১ জুলাই) রাজধানীর মিরপুর-১০ এর সি-ব্লকের ১৬ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর বাড়িতে গুপ্তধনের খোঁজে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে প্রশাসন ও পুলিশ। বাড়িটির মাটির নিচে কমপক্ষে দুই মণ স্বর্ণালংকার আছে এমন দাবি ওঠায় তথ্যটির সত্যতা যাচাই করতে সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলে অভিযান। তবে বাড়িটির ভিত্তি প্রস্তর দুর্বল হওয়ায় খোঁড়াখুঁড়ি স্থগিত করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ খুঁজে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী গুপ্তধনের সন্ধান চলবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন ও পুলিশ।

এর আগে, ‘গত ১০ জুলাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব নামের এক ব্যক্তি মিরপুরের এই বাড়িতে গুপ্তধন আছে দাবি করে মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর ১২ জুলাই রাতে কয়েকজন লোক ওই বাড়ির ভেতরে জোরপূর্বক প্রবেশের চেষ্টা করেন। এ ঘটনা জানিয়ে ১৪ জুলাই বাড়ির মালিক মুনিরুল ইসলাম থানায় একটি জিডি করেন। পরে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িটি খননের সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।

খোঁড়াখুঁড়ি স্থগিতের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উজ জামান বলেন, ‘আমরা বাড়িটির দুটি কক্ষের মেঝেতে সাড়ে চার ফুট গভীরে খনন করেছি। ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর দুর্বল হওয়ায় আর খনন করলে বাড়িটি দেবে যেতে পারে। তাই আপাতত খোঁড়াখুঁড়ি স্থগিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ খুঁজে তাদের পরামর্শ নিয়ে আবারও কার্যক্রম শুরু করা হবে।’

স্থানীয়রা বলছেন, তারা শুধু লোক মুখে শুনেই যাচ্ছেন যে, এই বাড়িতে গুপ্তধন আছে। কিন্তু কী আছে সেটি কেউ বলতে পারে না। আসলেই কি আছে, নাকি পুরোটা গুজব?
মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আরিফুর রহমান সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনার সত্যতা কতটুকু সেটি যাচাই করতেই বাড়ির মালিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খনন কার্যরক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এখানে কিছু থাকুক বা না থাকুক, আমরা খনন করে বিষয়টি যাচাই করে দেখছি। যদি কিছু পাওয়া যায়, তবে আইন অনুযায়ী তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মিরপুর-১০ নম্বর সি- ব্লকের একটি বাড়ির দারোয়ান আব্দুল আজিজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ গত  দিন দশেক ধরে ১০ পুলিশ এই বাড়ির সামনে পাহাড়া দিচ্ছে। বাড়িটির মাটির নিচে নাকি স্বর্ণালংকার আছে— মানুষ এমন কথা বলছে। খালি মানুষের কাছে শুনি, কিন্তু আসলে আছে কিনা তা জানি না ভাই।’

সরেজমিনে দেখা যায়, গুপ্তধন সন্ধানের অভিযান স্থগিত করার পরও মিরপুরের আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা ভিড় জমিয়েছেন ওই বাড়ির সামনে। তাদের সবার মনে প্রশ্ন আর কৌতূহল—মাটির নিচ থেকে কী বের হয়ে আসে? আসলেই কি মাটির নিচে কিছু গচ্ছিত আছে? ভিড় করা লোকজন এই আলোচনাতেই মশগুল হয়ে আছেন। এদিকে, শনিবার অভিযান স্থগিতের পর পুলিশের হেফাজতে রয়েছে বাড়িটি। বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির সামনে বসে পাহারা দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।

বাড়ির সামনে বসেছে পুলিশের পাহারাদীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত মিরপুরের সি-ব্লকের ১৬ নম্বর সড়কের নিজ বাড়িতে বসবাস করেন এ জেড এম শামসু উদ্দিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই এলাকায় বিহারীদের বসবাস ছিল। স্বাধীনতার পর এখানকার প্লটগুলো সব গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে যায়। এরশাদের আমলে (১৯৯০-৯১ সালে) এই প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানকার বর্তমান বাসিন্দারা বলতে গেলে প্রায় সবাই নতুন।

বাড়িটিতে ‘গুপ্তধন’ আছে এখবর কীভাবে শুনেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৮/১০ দিন আগে দেখি এখানে পুলিশের পাহারা বসেছে। তারা জানায় যে, এই বাড়িতে নাকি গুপ্তধন আছে। তারপর গুপ্তধনের খবরটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

কে রেখেছে এই গুপ্তধন?

গুপ্তধনের খবরটি প্রথমে প্রশাসনকে জানান মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুরের ওই বাড়িতে দিলশাদ খান নামের একজন বিহারী বসবাস করতেন। যুদ্ধের পর তিনি যখন বাড়িটি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান, তখন তার স্বর্ণালঙ্কারগুলো এই বাড়ির মাটির নিচে গচ্ছিত রেখে গেছেন। আমার বন্ধু সৈয়দ আলম  আমাকে এসব জানিয়েছেন।’

সৈয়দ আলম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সে আমার বাল্যকালের বন্ধু ছিল। কক্সবাজারের টেকনাফ সদরে আমাদের গ্রামে বসবাস করতো। একসঙ্গে স্কুলে পড়াশোনা করেছি। পরে আলম পাকিস্তানে চলে যায়, সেখানে বিয়ে করে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সেখানেই বসাবাস শুরু করে। আর দিলশাদ খান আমার বন্ধুর পরিচিত ও আত্মীয় হয়।’

আবু তৈয়ব আরও জানান, ‘বছর দুয়েক আগে বন্ধু (সৈয়দ আলম) বাংলাদেশে এসেছিল। তখন সে আমাকে ওই বাড়ির মাটির নিচে গচ্ছিত গুপ্তধনের বিষয়টি জানিয়েছিল। সে আমাকে বিষয়টি দেখতে বলে। এরপর থেকে এই গুপ্তধন কীভাবে উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে অনেক শ্রম দিয়েছি।’

তৈয়ব বলেন, ‘এ বছর রোজার ঈদের পর তার বন্ধু সৈয়দ আলম আবারও বাংলাদেশে আসে। এবার আমাকে কিছু না জানিয়ে ওই বাড়ির মালিক মনিরুল আলমের সঙ্গে সে গুপ্তধনের বিষয়ে বৈঠক করে। তারা নিজেরা গোপনে উদ্ধার করে এই গুপ্তধন ভাগাভাগির পরিকল্পনা করে।’

আবু তৈয়বের ভাষ্য মতে, ‘বন্ধু সৈয়দ আলম গুপ্তধনের ভাগ থেকে আমাকে বাদ দিলো, অথচ সে আমাকে ব্যবহার করেছে। তখন আমি চিন্তা করে দেখলাম, এই গচ্ছিত গুপ্তধন যার সে পাচ্ছে না, আমরাও কিছু পাচ্ছি না, এর মধ্যে তৃতীয় পক্ষ খাবে? তা হবে না। এটা তো আসলে  সরকারের প্রাপ্য। এরপর আমি গত ১০ জুলাই মিরপুর থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছি।’

২০১০ সালে সেলিম রেজা নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে এই বাড়িটি গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কিনেছিলেন মনিরুল আলম। মিরপুরের পল্লবীতে থাকেন তিনি। আর এই বাড়ি দেখাশোনা করেন শফিকুল ইসলাম ও সুমন নামে দুজন। শফিকুল ইসলাম ছিলেন বাড়ির কেয়ারটেকার। বাড়ির ভেতরে রয়েছে দুই সারিতে সাতটি কক্ষ। একটিতে শফিকুল ও সুমন থাকতেন। আর বাকি কক্ষগুলোতে ভাড়াটেরা থাকতেন। ৩/৪ মাস আগে ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিস দেওয়া হয়। তাদের বলা হয়— বাড়িটি ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করা হবে।

বাড়িতে গুপ্তধন গচ্ছিত থাকার খবর পেলেন কীভাবে? জানতে চাইলে বাড়ির মালিক মনিরুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থানীয়দের কাছে শুনেছি। তাছাড়া প্রতিদিনই নানা মানুষ বাড়ির সামনে ভিড় জমাতে থাকে। ফলে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফলে থানায় নিরাপত্তার চেয়ে এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সাধারণ ডায়েরি করি। পরে বাড়িটি খননের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার জন্য আবেদনও করি।’

তিনি বলেন, ‘যদি এখানে কিছু পাওয়া যায়, তবে রাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কোষাগারে তা জমা হবে- এবিষয়টি আমি থানায় লিখিতভাবে দিয়ে এসেছি।