গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার (৩১ আগস্ট) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডাক বিভাগের সর্টিং এয়াপোর্ট অফিসের গোডাউন থেকে ২৩টি কার্টুনে মোট ৪৬৮ কেজি এনপিএস খাত (নতুন মাদক) আটকের পর কাকরাইল থেকে রাতেই নাজিমকে আটক করা হয়। এরপর শনিবার রাতে (১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা শাখার নজরুল ইসলাম শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রিন-টির আদলে আসামি এই মাদক আমদানি করার পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে বিক্রি এবং বিদেশে রফতানি করার প্লান করছিল। তার সঙ্গে এই ব্যবসায় আরও কেউ জড়িত আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আসামি নাজিমের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।’
রাজধানীর রমনা থানাধীন শান্তিনগর মোড়ে সড়কের পাশেই অবস্থিত শান্তিনগর প্লাজা। ছয়তলা এই ভবনের নিচতলায় কনফেকশনারিসহ বিভিন্ন দোকান আছে। আর দ্বিতীয়তলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস কক্ষ। তৃতীয়তলা থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
রবিবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে কাকরাইল ১২৪/৭/এ শান্তিনগর প্লাজার দ্বিতীয় তলায় সরেজমিন দেখা গেছে, নিচ তলায় মার্কেটের ভেতর দিয়ে শেষ প্রান্তে থাকা সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই চোখে পড়বে নওশিন এন্টারপ্রাইজের ছোট একটি সাইনবোর্ড। সিঁড়ির সোজা গলিতে (রাস্তার পাশের অংশে) একটি বিউটি পার্লার রয়েছে। ওই গলিতে আরও কয়েকটি অফিস কক্ষ রয়েছে। সিঁড়ির ডান পাশের গলিটি অন্ধকারাচ্ছন্ন। দ্বিতীয় তলার ডান পাশের গলি ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই বাম পাশে গলির শুরুতে সবুজ রঙের স্টিকারযুক্ত অর্গানিক গ্রিন-টি’র স্টিকার লাগানো একটি প্রবেশ দ্বার। এটিই ‘নওশিন এন্টারপ্রাইজ’। শান্তিনগর প্লাজার দ্বিতীয় তলার পরিবেশ অনেকটাই নিরব প্রকৃতির। অফিসটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এর পাশেই রয়েছে হেয়ার সলিউশন নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই দুটি অফিসের ব্যবহারের জন্য একটি টয়লেট রয়েছে। সেই টয়লেটের দুই পাশেই দুটি দরজা থাকতে দেখা গেছে।
শান্তিনগর প্লাজার দ্বিতীয় তলার ব্যবসায়ীরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘মোহাম্মদ নাজিম গত পাঁচ মাস আগে সাবলেট হিসেবে সাত হাজার টাকায় অফিসটি ভাড়া নেন। এক মাস ডেকোরেশনের কাজ করার পর তিনি অফিসে ওঠেন।অফিসের ভেতরে খুব পরিপাটি। সপ্তাহে ৩-৪ দিন দুপুরের পর তিনি অফিসে আসতেন। অফিসে প্রবেশর পর দরজা লক করে রাখতেন। তিনি আমাদের সঙ্গে খুব বেশি কথা বলতেন না। গ্রিন টি’র আদলে তিনি এনপিএস মাদকের ব্যবসা করতেন, সেটি কারও জানা ছিল না। আমরা প্রায় সময় তার মাল আসতে দেখতাম, কিন্তু কোনও দিন কাস্টমার আসতে দেখিনি।’
দ্বিতীয়তলার হেয়ার সলিউশন প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুটি কক্ষই ১৩ হাজার টাকায় আমি ভাড়া নিয়েছিলাম। আমার ব্যবসার অবস্থা নাজুক হয়ে যাওয়ার কারণে অর্ধেক অংশটি ভাড়া দিই। গত পাঁচ মাস আগে নাজিম সাহেব এসে সাবলেট হিসেবে ভাড়া নেন। তবে তিনি গ্রিন-টি বিক্রির কথা বলেই এখানে এসেছেন।’
নিউ শান্তিনগর হারবাল প্রতিষ্ঠানের মালিক আরব আলী গাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সে আমাদের এপর্যন্ত দুদিন তার গ্রিন-টি’র চা খেতে দিয়েছে। ওই পাতা গরম পানিতে দিয়ে আমরা খেয়েছি, খুব বিশ্রি গন্ধ, মুখে কষ কষ লাগে। গ্রিন-টির দাম জানতে চাইলে তিনি বলতেন– এটা অনেক দামি গ্রিন-টি, এগুলো ডলারে বিক্রি হয়। বাংলাদেশে এক কেজির দাম ১৪-১৫ হাজার টাকা।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবার জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফ এনপিএস মাদকের চালানটি ঢাকায় ‘নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজ’ এর নামে পাঠায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ এড়াতে নওশিন এন্টারপ্রাইজের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া চালানের তারিখে ৩০ আগস্ট থাকলেও সাল উল্লেখ করা ছিল ২০১৬। এরপরও চালানটি বিভিন্ন রুট পরিবর্তন করে গত ২৭ আগস্ট ঢাকায় এসে পৌঁছায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি নাজিম জানায়, ‘সে দীর্ঘদিন দুবাইতে ছিলেন। সেখানে ইথিওপিয়ান এক নাগরিকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে ঘনিষ্টতা বাড়ে। ওই ব্যক্তির সঙ্গে এনপিএস খাত আমদানি করে আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাচারের চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী নাজিম দেশে ফিরে বেশ কয়েক মাস ধরে এই ব্যবসা করে আসছিল। এ পর্যন্ত ৪-৫টি চালান দেশে এনেছেন এবং দুটি চালান বিদেশে পাঠিয়েছে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, আসামির মোহাম্মদ নাজিমের একাধিক ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। অ্যাকাউন্টগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটিতে আট হাজার ডলার এবং অন্যটিতে নয় হাজার ডলার ট্রানজেক্ট হয়েছে। এনপিএস মাদক চালালের জন্য তার একাউন্টে এই ডলার পাঠানো হয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়াতে। নাজিমের ফ্ল্যাট-বাড়ি সবই আছে। সে অনেকটা রাজকীয় জীবন-যাপন করে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। ধারণা করা হচ্ছে, এই ব্যবসায় করেই সে অনেক টাকার মালিক হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো উপঅঞ্চলের (উত্তর) সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ খোরশিদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই খাত মাদকটি পাচারের পেছনে অনেক বড় একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। তবে এই সিন্ডিকেটে বাংলাদেশের কারা জড়িত খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’