‘১০ বছর বিদেশে থেকে জেল খেটে দেশে ফেরা লাগে’





2222

মানিকগঞ্জের আমির হোসেন ১০ বছর আগে সৌদি আরবে যান ভাগ্য বদলানোর আশায়। প্রতিবছরই তিনি ছুটি কাটাতে দেশে আসেন। সম্প্রতি দেশে এসে চার মাস আগে আবারও কাজে যোগদান করতে সৌদি আরবে যান। কিন্তু এবার ঘটলো বিপত্তি। তার আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মালিক নতুন করে আর আকামা (কাজের অনুমতি) দেয়নি। আমির হোসেনের অভিযোগ— আকামার জন্য টাকা দেওয়ার পরও মালিক অনীহা দেখান। এই আকামা করতে এক এক সময় খরচ পড়ে প্রায় ১২-১৪ হাজার সৌদি রিয়াল। নিরুপায় হয়ে দেশে ফেরার জন্য আমির হোসেন নিজেই ধরা দেন পুলিশের কাছে। চার দিন বন্দি ছিলেন সফর জেলে। এরপর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) আরও ১০৭ জনের সঙ্গে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন আমির হোসেন। দেশে ফিরে এসে আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘১০ বছর বিদেশে থেকে জেল খেটে দেশে ফেরা লাগে’
আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে প্রতিবছর বিদেশে কাজের খোঁজে যাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকরাও যাচ্ছেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। আবার কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে জমিয়ে ফেলেন ব্যবসা। কিন্তু এই মুহূর্তে কারও ভাগ্যই সহায় হচ্ছে না। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ সৌদি আরবে চাকরি করতে যান। কিন্তু এবার সেদেশে যাওয়ার সংখ্যার চেয়ে ফিরে আসার সংখ্যা বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছেন ফিরে আশা শ্রমিকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সৌদি আরবের নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে দেশটির সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন সেদেশে অবস্থানরত বিদেশি শ্রমিকরা। সৌদি সরকার ১২টি সেক্টরকে সৌদিকরণ করার ঘোষণায় গত ১৫ মাসে ৭ লাখ ২০০ জন প্রবাসী শ্রমিক সেদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। সৌদি আরব সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৭ সালেই সৌদি আরব ছেড়ে গেছেন ৪ লাখ ৬৬ হাজার বিদেশি শ্রমিক। এছাড়া, বিগত তিন মাসে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ জন শ্রমিক শ্রমবাজার ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে কী পরিমাণ বাংলাদেশি আছে, তা বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস। তবে শুধু অক্টোবর মাসে এপর্যন্ত (১১ অক্টোবর) সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন ৫০০-এর বেশি পুরুষ শ্রমিক।
333

দেশে ফিরে আসা প্রায় সব শ্রমিকদের অভিযোগ— সৌদি সরকার যাকে পাচ্ছে ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। জামালপুরের তারা মিয়া আড়াই বছর আগে সৌদি আরব যান। সেখানে তিনি ক্লিনারের কাজ করতেন। দেশে ফিরে এসে তিনি বলছেন— সৌদি আরবে এখন কোনও কাজ নাই। তারা মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৯ লাখ টাকা খরচ করে গেছি, প্রায় ৮ লাখ টাকার মতো উঠাতে পেরেছি। সৌদি আরবে কাজ নেই কোনও, তাই পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে দেশে চলে এসেছি।’
কিন্তু তারা মিয়ার মতো ভাগ্য সবার নয়। সৌদি থেকে ফেরত আসা বেশির ভাগ পুরুষ শ্রমিকের কারও হাতে কোনও ব্যাগ দেখা যায়নি। এমনকি কোমরের বেল্টটাও পড়ার সুযোগ পাননি— জানালেন ফিরে আসা কয়েকজন শ্রমিক। তাদের ভাষ্য— মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময়ও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ কারও কথা শুনছে না। আকামা থাকা সত্ত্বেও ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
ভোলার আলাউদ্দিন বলেন, ‘পুলিশের কাছে ধরা পড়লে ২০ হাজার রিয়াল জরিমানা করে মামলা দেয়, যার কারণে কফিল (নিয়োগকর্তা) দায় দায়িত্ব নিতে চান না। দাম্মামের সফর জেলে এখনও অনেক বাংলাদেশি আটক আছেন। জেলের ভেতরে পা রাখার জায়গাটুকুও নেই।’
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মোরশেদ আলম ১৪ বছর ধরে থাকছেন সৌদি আরবে। তিনিও বুধবার (১০ অক্টোবর) দেশে ফিরেছেন। সৌদি আরবে কাজ নেই উল্লেখ করে মোরশেদ বলেন,‘গণহারে ধরপাকড় হচ্ছে সৌদিতে। কোনও বাছাবাছি নাই। দেশে ফেরার অপেক্ষায় এখনও অনেকে জেলে আছেন। আমি নিজেও তিন মাস জেলে ছিলাম।’
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ১৫৮টিরও বেশি দেশে জনশক্তি রফতানি করে বাংলাদেশ। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বিদেশে। ফলশ্রুতিতে দেশে রেমিটেন্স হিসেবে এসেছে প্রায় ১৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে এসেছে সবচেয়ে বেশি, যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, ২০১৭ সালে এ যাবত কালের সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বিদেশে, যার পরিমাণ ১০ লাখেরও বেশি।