আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করতেই ভাঙা হচ্ছে বিজিএমইএ ভবন

পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে বিজিএমএ ভবনের একটি ফ্লোর সিলগালা করে রাজউক

হাতিরঝিলে অবৈধভাবে বানানো বিজিএমইএ ভবনটি অবশেষে ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সকালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবনটি ভাঙার জন্য সেখানে গিয়ে মালপত্র সরিয়ে নেওয়ার নোটিশ দেওয়ার পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ভবনটির সবগুলো ফ্লোর ও মূল ফটক সিলগালা করে দিয়েছে। এর ফলে প্রতাপশালী সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ)  ববনটি রক্ষার সব চেষ্টা থেমে গিয়ে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে আদালেতের আদেশ। আর এর মধ্য দিয়ে দেশ আইনের শাসন  প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ হয় ২০০৭ সালে। কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের অভিযোগ ছিল, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে এবং উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করার মাধ্যমে ওই ভবন গড়ে তোলা হয়েছে।’

পরে দেশের একটি জাতীয় দৈনিক ভবনটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে তা আদালতের নজরে আনা হয় এবং ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর হাইকোর্ট ভবনটি ভাঙার বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। ওই রুলের শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিজিএমইএ ভবনকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ করা জমি ১৯৯৮ সালে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো যেভাবে বিজিএমইএকে দিয়েছে, তা বেআইনি বলে উল্লেখ করা হয় এবং রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে ভবনটি ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে জলাধার আইন ভেঙে নির্মিত বিজিএমইএ ভবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে ‘একটি ক্যান্সার’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।

এরপর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ আপিল দায়ের করেন। আপিল শুনানিকালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। এরপর দীর্ঘ শুনানি শেষে বিজিএমইএ’র ওই আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘বেগুনবাড়ি খাল’ ও ‘হাতিরঝিল’ জলাভূমিতে অবস্থিত ‘বিজিএমইএ কমপ্লেক্স’ নামের ভবনটি নিজ খরচে অবিলম্বে ভাঙতে আবেদনকারীকে (বিজিএমইএ) নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। এতে ব্যর্থ হলে রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) ভবনটি ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হলো। এক্ষেত্রে ভবন ভাঙার খরচ আবেদনকারীর (বিজিএমইএ) কাছ থেকে আদায় করবে তারা (রাজউক)।

পরে ২০১৭ সালের ৫ মার্চ আপিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা বিজিএমইএ’র আবেদনটিও খারিজ হয়ে যায়। এরপরও ভবন না ভাঙতে আদালতের কাছে বারবার সময় চান বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ। তবে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল মুচলেকা দিয়ে ভবন ভাঙতে এক বছর সময় পান বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ।

বিজিএমইএ’র মুচলেকায় থাকা তিনটি শর্তে বলা হয়, ‘আমাদেরকে এক বছর সময় দেওয়া হলে এক. আমরা আর সময় চাইবো না; দুই. আদালত যে আদেশ দেবেন তা মেনে চলবো; এবং তিন. আদালতের সময় শেষে বিজিএমইএ'র পরিচালনা পর্ষদে যারাই থাকবেন তারা ভবন ভাঙতে দায়বদ্ধ থাকবেন।’

মুচলেকায় থাকা তিনটি শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এক আদেশ দেন। ওই আদেশে বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে চলতি বছরের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেন আদালত।

বিজিএমইএ’কে বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সংগঠনটির পক্ষ থেকে ভবনটি ভাঙার জন্য কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় আজ মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সকালে ভবনটি ভাঙার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয় রাজউক।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আদালত সমস্ত কিছু বিবেচনা করেই দেখেন ওই জায়গায় ভবন করা ঠিক হয়নি। অনুমোদন না থাকায় ভবনটি ভাঙতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। যদিও তারা কয়েকবার সময় নিয়েছে। তবে সব সময় শেষে আদেশটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

তিনি  আরও  বলেন, বিজিএমইএ ভবন ভাঙার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত যে আদালত যে রায় দেন সেটিই সঠিক। আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে মর্মেও জনমনে একটি বার্তা যাবে।

এদিকে উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন হওয়া প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভবনটি ভাঙার ফলে জনগণের কাছে এই বার্তা যাবে যে, যার যত শক্তিই থাকুক না কেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কোনও শক্তিই অন্তরায় হয়ে থাকে না। চূড়ান্তভাবে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন হতেই হয়। এই বার্তাটি জনগণের কাছে যাচ্ছে দেখে আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমরা খুশি। ’

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করায় আমরা বিজিএমইএ’কে ধন্যবাদ জানাই। একইসঙ্গে আগামীতে এ ধরনের কাজ থেকে অনেকেই বিরত থাকবেন বলেও আমরা প্রত্যাশা করছি।’