অবৈধ সংযোগ, মিটার টেম্পারিংসহ তিতাসের ২২টি খাতের দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানী ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে ২২ খাতের দুর্নীতির বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। তিতাসের কোন খাতে কিভাবে দুর্নীতি হয় সে বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুকেও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে দুদক। বুধবার (১৭ এপ্রিল) সচিবালয়ে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক প্রতিমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতির খাত সংক্রান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। এ সময় দুর্নীতি প্রতিরোধে ১২ দফা সুপারিশও করা হয়।
দুদকের প্রতিবেদন হাতে পেয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার কঠোর অবস্থানে আছে। দুর্নীতিবাজরা ছাড় পাবে না।
দুদক কমিশনার বলেন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিতাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানী ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে তিতাসের দুর্নীতির খাত হিসেবে যে ২২ খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে:
১. অবৈধ সংযোগ দেওয়ার দুর্নীতিই তিতাসে সবচেয়ে বেশি হয়।
২. কেউ নতুন সংযোগের জন্য আবেদন করলে বা অবৈধ সংযোগ বৈধ করার জন্য আবেদন করলে সহজে অনুমোদন পায় না।
৩. অবৈধ লাইন পুনঃসংযোগ: ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও রাতের আঁধারে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়।
৪. অবৈধ সংযোগ বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়া।
৫. অদৃশ্য হস্তক্ষেপে অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট এলাকার তিতাস কর্মকর্তার (ম্যানেজার) সমন্বয়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ কমিটি রয়েছে। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কমিটি রয়েছে। কিন্তু কমিটি কাজ করে না।
৬. গ্যাস সংযোগে নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না।
৭. একই কর্মকর্তার একাধিক দায়িত্ব পালনও তিতাসে দুর্নীতি বাড়াচ্ছে।
৮. বাণিজ্যিক গ্রাহককে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ প্রদান করেও দুর্নীতি হচ্ছে।
৯. মিটার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে দুর্নীতি হচ্ছে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা ঘুষের বিনিময়ে মিটার টেম্পারিং করে গ্রাহকের প্রকৃত বিল গোপন করছে।
১০. অনুমোদনের অতিরিক্ত বয়লার ও জেনারেটরে গ্যাস সংযোগ দিয়েও দুর্নীতি হচ্ছে।
১১. যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বা আবাসিক গ্রাহক বৈধভাবে সংযোগ নিতে চায় বা মিটারের নাম পরিবর্তন করতে চায় তাদের কাছ থেকেও অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়।
১২. ঢাকা ও আশেপাশের অনেক কোম্পানির মিটার বাইপাস করে অবৈধ সংযোগ আছে। তিতাসের কর্মীরা ঘুষের বিনিময়ে বাইপাসের মাধ্যমে গ্যাসের সংযোগ দেয়।
১৩. ইচ্ছাকৃতভাবে তিতাসের কর্মচারীরা গৃহস্থালিতে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দিয়ে ওই সময়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস বাইপাস করে।
১৪. তিতাসসহ অন্যান্য কোম্পানি অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রাহক পর্যায়ে অনুমোদনের কম/বেশি গ্যাস সাপ্লাই দেয়। সাপ্লাই ভেরিয়েশন পরিমাপ করার জন্য ইভিসি (ইলেকট্রনিক ভল্যুম কারেকটর) মিটার ব্যবহার করার কথা থাকলেও হয় না।
১৫. কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে অর্থের বিনিময়ে শিল্প এলাকায় পোস্টিং নিয়ে আছে। তারা সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি করছে।
১৬. ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, আবাসিক খাতে এস্টিমেটেড প্রবাহ ছিল ১০,৩১৭,৬৯,৩৫,৫৬৮ সিএফটি। কিন্তু ব্যবহার হয়েছে ৮,৮৩৯,৭৪,৯৬,৮৯৯ সিএফটি। দেখা যায় এস্টিমেশন অপেক্ষা ১,৪৭৭,৯৪,৩৮,৬৬৯ সিএফটি বা ৪১ কোটি ৮৫ লাখ ৬ হাজার ৭০৩ ঘনমিটার গ্যাস কম ব্যবহার হয়েছে। যার মূল্য ২৯২ কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯২১ টাকা। অথচ এস্টিমেশন থেকে গ্যাস কম ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে।
১৭. অবৈধ চুলাপ্রতি বৈধ চুলার সমান টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করা হয়।
১৮. গ্যাস বিক্রি বেশি দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
১৯. ভুয়া সংকেত দিয়ে অবৈধ গ্রাহকের কাছে বিল আদায় করা হয়।
২০. আঞ্চলিক ব্যাংক হিসাব থেকে তিতাসের মাদার অ্যাকাউন্টে যথাসময়ে টাকা স্থানান্তর হয় না।
২১. দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া বিল আদায় না করেও দুর্নীতি হয়।
২২. দরপত্রে অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
তিতাসের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের সুপারিশ:
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের দুর্নীতি প্রতিরোধে ১২ দফা সুপারিশ দিয়েছে দুদক। এগুলো হচ্ছে:
১. প্রি-পেইড মিটার: মিটার টেম্পারিং বন্ধ ও গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের অপচয় বন্ধ করতে প্রি-পেইড মিটার চালু করা যেতে পারে।
২. মোবাইল কোর্টের আদলে আকস্মিক পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরে ফলোআপ থাকতে হবে।
৪. দীর্ঘদিন শিল্প এলাকায় এবং একই বিভাগে কারও পোস্টিং রাখা যাবে না।
৫. জনবলের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
৬. অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৭. অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৮. অডিট আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
৯. সিস্টেম লসের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করতে হবে।
১০. নিজস্ব সার্ভিলেন্স এবং মোবাইল কোর্ট থাকতে হবে।
১১. নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ রাখা যেতে পারে।
১২. বকেয়া পাওনা আদায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।