এদিকে, গত ১৭ এপ্রিল এসব হত্যা মামলার অগ্রগতি আদালতকে জানানোর নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ। ২৩ এপ্রিল রিটের শুনানি থাকলেও আদালত এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত দেননি।
সাগর-রুনি হত্যা মামলা
রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হন ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। এই নৃশংস জোড়া খুনের পর প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্তভার গ্রহণ করে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুমাস পর (১৮ এপ্রিল, ২০১২) গোয়েন্দা পুলিশের তখনকার উপকমিশনার (ডিসি ডিবি) ও ডিএমপির মুখপাত্র এবং বর্তমানে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজমের অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম উচ্চ আদালতে উপস্থিত হয়ে তদন্তে ব্যর্থতার কথা জানান। তখন উচ্চ আদালত সুদক্ষ, অভিজ্ঞ এবং এএসপি পদমর্যাদার নিচে নয়— এমন একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে এই মামলার তদন্ত করাতে র্যাবের ডিজিকে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে এই মামলার তদন্ত করছে র্যাব। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত করা হয়। এরপর গত সাত বছরে র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন একাধিকবার।
সোহাগী জাহান তনু হত্যা
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার তদন্তও শেষ হয়নি গত তিন বছরে। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি বাসায় টিউশনি করতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। কয়েকঘণ্টা পর ওই রাতেই তার স্বজনরা বাসার অদূরের একটি জঙ্গলে তনুর লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। পরদিন তনুর বাবা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক। তাদের বাসাও সেনানিবাসের মধ্যেই।
প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে গোয়েন্দা পুলিশের পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কুমিল্লা শাখাকে। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কুমিল্লা সিআইডির ইন্সপেক্টর জালাল আহমেদ।
মাহমুদা খানম মিতু হত্যা
চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড় এলাকায় ২০১৬ সালের ৫ জুন দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রামের তখনকার এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। সেদিন সকালে ছেলে মাহিরকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে গোয়েন্দা পুলিশকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ডিবির ইন্সপেক্টর রকিব উদ্দিন। ওই বছরের ১১ জুন তদন্ত কর্মকর্তাকে বদল করে গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার ও বর্তমানে অ্যাডিশনাল এসপি মো. কামরুজ্জামানকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। এরপর থেকে গত প্রায় তিন বছর এই মামলার তদন্ত করছেন তিনি।
কী কারণে তদন্তে বিলম্ব হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা তো তদন্তাধীন। কারণ, তো থাকেই। আসামি ধরার বাকি আছে। আরও কিছু বিষয় আছে। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যে কারণে তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিতে বিলম্ব হচ্ছে।’
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার তদন্ত শেষ হয়নি ছয় বছরেও। গত ৫ মার্চ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর শেষ হয়েছে। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকালে শহরের শায়েস্তা খান সড়কের বাসা থেকে বেরিয়ে আর বাসায় ফেরেনি ত্বকী। পরে ৮ মার্চ সকালে শহরের চারারগোপে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ত্বকীর লাশ পাওয়া যায়। সে রাতেই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন তার বাবা তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির জেলা শাখার আহ্বায়ক রাফিউর রাব্বি।
ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কবে নাগাদ জমা দেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে কাজী শামশের উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। এটার তদন্ত চলছে। কবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে সেটা বলা কঠিন।’
কী কারণে বিলম্ব হচ্ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোনও কারণ নেই। স্পর্শকাতর মামলাগুলো সতর্কভাবেই তদন্ত করতে হয়।তদন্ত শেষ হলেই চার্জশিট দেওয়া হবে আদালতে।’
মাওলানা ফারুকী হত্যাকাণ্ড
রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট জঙ্গিদের হাতে খুন হন বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’ এর কাফেলা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও হাইকোর্ট মাজার মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। হত্যাকাণ্ডের একদিন পর ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আট-নয় জনকে আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা ও ডাকাতির অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে। মামলাটি ডিবিতে স্থানাস্তরের পর তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ইন্সপেক্টর জুলহাস উদ্দিন আকন্দকে। এক বছরের মাথায় ২০১৫ সালের শেষের দিকে মামলাটি ডিবি থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়। তখন মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির ইন্সপেক্টর আরশেদ আলী মণ্ডলকে। এরপর তিনি সিআইডি থেকে বদলি হয়ে গেলে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের সিনিয়র এএসপি (বর্তমানে অ্যাডিশনাল এসপি) মাহমুদ তালুকদারকে। মামলাটি এখনও তিনিই তদন্ত করছেন।
পীর লুৎফরসহ গোপীবাগের ছয় হত্যা
রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বর বাড়ির দোতলায় ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাতে কথিত পীর লুৎফর রহমান (৬০) ও তার ছেলে সরোয়ার ইসলামসহ (৩০) ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বলা হয়, লুৎফর রহমান নিজেকে পীর ও ইমাম মাহদীর সেনাপতি হিসেবে পরিচয় দিতেন। খুন হওয়া অন্য চারজন হলেন— লুৎফরের খাদেম ও ওই বাসার কেয়ারটেকার মনজুর আলম (৩৫) মুরিদ সাইদুর রহমান ওরফে শাহিন (৩০), মজিবুল সরকার (৩২) ও মোহাম্মদ রাসেল (৩০)।
এই ছয় খুনের মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ঘটনার প্রায় দুবছর পর গোয়েন্দা পুলিশের তখনকার যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম এই ঘটনার জন্য জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্যদের দায়ী করেন। এরপরও আরও তিন বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। সম্প্রতি বর্তমানে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে (সিটিটিসি)।
ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যা
রাজধানীর পূর্ব গোড়ানের ৮ নম্বর রোডের ১৬৭ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার ভাড়া বাসায় ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট দুপুরে ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের কয়েকঘণ্টা পর দায় স্বীকার করে আনসার আল ইসলাম নামের একটি জঙ্গি সংগঠন বিভিন্ন গণমাধ্যমে
ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যা
ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদকে রাজধানীর সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে। নাজিমুদ্দিন সামাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের এলএলএম-এর বি সেকশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। এছাড়া সিলেট জেলা
গোপীবাগের ছয় খুন, ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয় ও ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিটিসির উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তদন্তের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। চার্জশিট দেওয়ার প্রস্তুতিও রয়েছে আমাদের। জুলহাজ-তনয় মামলাটির চার্জশিট দেবো কয়েকদিনের মধ্যে। এরপর অন্য মামলাগুলোর চার্জশিট চূড়ান্ত করে আদালতে দেওয়া হবে।’